বিশ্বজিৎ মান্না
গালভরা নাম সাংবাদিক। কিন্তু নুন আন্তে পান্তা ফুরোনো অবস্থা। তবুও বাড়ির দরজা, সাইকেল বা জাঙ্গিয়াতেও পারলে ‘প্রেস’ লিখে রাখে। বাঙালি সাংবাদিকদের অবস্থাটা ঠিক এরকমই। তাতে তাদের দোষ কতটা, সে বিষয়ে মন্তব্য করার আগে বলতে হয় সাংবাদিকতা নিয়ে বাঙালির এত উৎসাহ কেন।
একটা সময় ছিল যখন পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন থেকে সমস্ত জায়গায় এলিজিবল ব্যাচেলার মানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের মতো পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিবেচনা করা হত। কিন্তু সময় পাল্টেছে। বদলে গিয়েছে সমাজের স্টেটাস সিম্বল। সেই সঙ্গে চিরাচরিত পেশার পাশাপাশি অল্টারনেটিভ কেরিয়ার হয়ে উঠেছে সাংবাদিকতা বা হোটেল ম্যানেজমেন্ট। বাঙালি সর্বদা আবেগে গা ভাসানো একটা জাতি হিসেবে পরিচিত। তার আবেগে একটু সুড়সুড়ি দিলেই সে লাফাতে শুরু করে। ঠিক এই জায়গাতেই আর পাঁচটা পেশার থেকে শত মাইল এগিয়ে রয়েছে সাংবাদিকতা। মালকিপক্ষ এই ব্যাপারটা ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছে। তাই তারাও ঝোপ বুঝে কোপ মারছে।
কোভিড-১৯ মহামারি দেখা দেওয়ার পর সমগ্র বিশ্বে বেকারত্বের হার বেড়ে গিয়েছে। চলছে ছাঁটাই। সাংবাদিকদেরও চাকরি গিয়েছে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে যে বিষয়টা আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়, সেটা হল বাঙালি সাংবাদিকদের অবস্থা। এটা বললে বোধহয় ভুল হবে না যে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বাংলা সংবাদমাধ্যম এবং বাঙালি সাংবাদিক বলে কিছু থাকবে না। প্রথমত, বাংলা মিডিয়ার অবস্থা এতটাই খারাপ, বা এটাকে ইচ্ছাকৃতভাবে এতটাই খারাপ করে রাখা হয়েছে যে, ভদ্র, সভ্য, শিক্ষিত কোনো ব্যক্তি আগামী দিনে এই পেশায় আসার আগে শতবার ভাববেন। সবচেয়ে উদবেগজনক বিষয় হল বাংলা মিডিয়ায় বেতন পরিকাঠামো। কলকাতা সহ গোটা পশ্চিমঙ্গে প্রায় সমস্ত মিডিয়া হাউজে গড় বেতন মাসে ২০০ মার্কিন ডলারেরও কম। যা থেকে স্পষ্ট হয় বাঙালি সাংবাদিকরা কি বঞ্চনার শিকার হন। তবুও তাদের কাছে জব স্যাটিসফ্যাকশন হল তিনি সাংবাদিক। গাড়ি না হলেও নিদেন পক্ষে বাইকে ‘প্রেস’ লিখে ঘুরতে পারেন। বাইকের কাগজপত্রে কোনো গণ্ডগোল থাকলেও ট্রাফিকগার্ড বাইক না ধরে ছেড়ে দেয় এই ‘প্রেস’ লেখা দেখে। এছাড়া আরও অনেক বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে রয়েছে বাড়তি সম্মান। মানুষ কি নিয়ে পরেরদিন সকালে চায়ের দোকানে আড্ডা দেবে, কি নিয়ে আলোচনা করবে, কি নিয়ে চায়ের কাপে তুফান উঠবে, তা ঠিক করে দেন সাংবাদিক বা সাব এডিটররা। কিন্তু এটা দিয়ে বাস্তবে চলা খুব মুশকিল।
অন্যান্য ভাষার মিডিয়ার থেকে বাংলা মিডিয়ার অবস্থা একটু বেশি সংবেদনশীল। বিশেষত সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে বাংলা মিডিয়া সাম্রাজ্যে হাতে গোনা কয়েকটি মিডিয়া হাউজ রীতিমতো মোনোপলি তৈরি করেছে। যেখানে কর্তৃপক্ষের শর্ত মেনে না নিলে সেই সাংবাদিককে সরাসরি চাকরি থেকে বরখাস্ত করার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। প্রশ্ন হল, একজন শিক্ষিত, তরুণ বাঙালি সাংবাদিক এটা কতদিন ধরে সহ্য করবেন? বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী একজন অনুবাদকের গড় বেতন যেখানে মাসে ৫০০ মার্কিন ডলারেরও অধিক, সেখানে সাংবাদিকরা তার অর্ধেকেরও কম বেতনে কাজ করেন।
লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে কলকাতা সহ রাজ্যের একাধিক মিডিয়া কোম্পানিতে ব্যাপক ছাঁটাই চলছে। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের কথা বাদই দিলাম, এরাজ্যের কথা প্রসঙ্গে বলতে হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে সাংবাদিকদের অর্ধেক বেতনে কাজ করতে, কিংবা তাতে রাজি না হলে সরাসরি ছাঁটাই করা হচ্ছে। লকডাউন শুরু হয়েছে মাস তিনেক। একটা মিডিয়া হাউজের সম্পূর্ণ পরিকাঠামো এই নব্বই দিনে ভেঙে পড়তে পারে না। যে মিডিয়া হাউজগুলি বেতন বৃদ্ধি না করে ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছে, তারাই আবার ফলাও করে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করছে, তারা প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে বিশাল টাকা দান করেছে। অর্থাৎ তারা নিজেদের পিআরটা ভালো বোঝেন। একটা মিডিয়া হাউজের পক্ষে এক লক্ষ টাকা দান করাটা কোনো বড় ব্যাপার নয়। এই কঠিন সময়ে একজন কর্মীর দায়িত্ব নেওয়াটা বড় কথা। অথচ তারা করোনার ত্রাণ তহবিলে অর্থ দান করার পরের দিনই নিজেদের কর্মীদের ছাঁটাই করেছে। বলেছে, সংস্থার যথেষ্ট রোজগার হচ্ছে না। বিজ্ঞাপন বন্ধ। ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রিন্ট মিডিয়ার কথা নাহলে কিছুটা বোঝা যায়। তবে ওয়েব মিডিয়ার সঙ্গে লকডাউন বা কোভিড মহামারির সেই অর্থে কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ ওয়েব মিডিয়া থেকেও বিপুল ছাঁটাইয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমত ওয়েব মিডিয়ার রোজগারের মূল উপায় হল গুগল অ্যাড সেন্স, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিংয়ের মতো উপায়। নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজন প্রাইমের মতো ইন্টারনেট ভিত্তিক সংস্থাগুলি লকডাউনের সময় অভাবনীয় রোজগার করেছে। কারণ লকডাউনের কারণে প্রচুর মানুষ এখন বাড়িতে রয়েছেন। তাদের হাতে অনেক সময়। সঙ্গে সস্তার ইন্টারনেট। তাই প্রচুর মানুষ অনলাইনে সময় ব্যয় করছেন। এছাড়া প্রায় অধিকাংশ ওয়েব মিডিয়াতে লকডাউনের সময় ট্রাফিক বা সাইটে ভিজিটর্সের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দিনে ৫০০০ মার্কিন ডলার রোজগার করাও কোনো কোনো সাইটের কাছে খুব সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই সংস্থাগুলি লকডাউনের দোহাই দিয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি বেতনের কর্মীদের ছাঁটাই করছে। সেই জায়গায় তুলনামূলকভাবে স্বল্প বেতনে কর্মী নিয়োগ করছে। এখন প্রশ্ন হল, এরকম কতদিন চলবে। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলা মিডিয়ার যা অবস্থা, তাতে শিক্ষিত, প্রতিভাবান যুবকরা সাংবাদিকতায় আসছেন না। মূলত মধ্যে মেধার লোকজনরাই কিছু না পেয়ে সাংবাদিকতায় ভিড় জমাচ্ছেন। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা মাসকম জার্নালিজম প্রতিষ্ঠানগুলিও তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আখেরে লাভ কিছু হচ্ছে না। সাংবাদিকতার স্বপ্ন দুচোখে নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করার কিছু দিনের মধ্যেই বাঙালি সাংবাদিকরা দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠছেন। অফিসের নাম ভাঙিয়ে আনডিউ অ্যাডভান্টেজ নিচ্ছেন। তাতে সাংবাদিকতার মান খারাপ হচ্ছে। এর পেছনে দায়ী মালিকগোষ্ঠী। তারা যদি সাংবাদিকদের ন্যূনতম বেতন সহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা প্রদান করতেন, তাহলে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হত না।