স্বপনকুমার ভূঁইয়া
(দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ মহকুমার পাথরপ্রতিমার দক্ষিণ লক্ষ্মী নারায়ণপুরের বাসিন্দা। বর্তমানে কেরলের ত্রিশুর জেলার চালকুড়িতে একটি শোরুমের কর্মী)
লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই কেরলে থমথমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। করোনাভাইরাসে এখানে মৃতের সংখ্যা বেশি না হলেও আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। ট্রেন নেই, ফ্লাইট নেই। আমরা তাই বাড়ি ফিরতে পারছি না। আমার সঙ্গে পাথরপ্রতিমার প্রায় ১৭ জন আছেন। মঙ্গলবার স্থানীয় পঞ্চায়েতের সদস্যরা আমাদের কাছে এসেছিলেন। তারা আমাদের এক ধরণের ডাস্ট দিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন এটা জলের সঙ্গে ফুটিয়ে খেতে। তাতে নিরাপদে থাকা যাবে। এছাড়া তারা আমাদের কিছু হোমিওপ্যাথি ওষুধও দিয়ে গিয়েছেন। যদিও এখনও স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে আমাদের কোনো রেশন দেওয়া হয়নি।
বাড়িতে সবাই চিন্তিত। বাবা, মা, বোন, দিদি রোজ ফোন করছে। আমার খবর নিচ্ছে। এখন আমার বাড়ি ফেরার কোনো প্ল্যান ছিল না। টানা ১০ মাস হল আমি কেরলে আছি। প্ল্যান ছিল একেবারে দূর্গা পূজার সময় বাড়ি যাব। দেশজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারির আকার নেওয়ায় এখন এই পরিকল্পনায় বদল আনতে হচ্ছে। বাড়ি ফিরতে চাই। শুধু আমি নই, আমার মতো সুন্দরবনের অনেকেই এখানে এখন ফেঁসে গিয়েছে। মূলত খাবার-দাবার নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এখানে সবজির আকাল দেখা দিয়েছে। আমি কোনোরকমে কিছু ডিম, চাল পেয়েছি। এই স্টক শেষ হলে কি হবে জানি না। খুব আতঙ্কে আছি। কেরলে এখন দোকানপাট সবই বন্ধ। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি।
আমার মালিক এসেছিল কয়েকদিন আগে। আমাকে কিছু আটা, পেঁয়াজ, টম্যাটো এবং ২০০০ টাকা দিয়ে গিয়েছেন। আগে হোটেলে খেতাম। তবে লকডাউনের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। আমাকে একটা ঘর দেওয়া হয়েছে। সেখানে গ্যাস স্টোভের ব্যবস্থা রয়েছে। আপাতত সেখানেই চাল ফুটিয়ে খাচ্ছি। তবে স্টক সীমিত। এটা ফুরিয়ে গেলে কিভাবে খাবার জোগাড় করব জানি না।
করেল এমনিতেই ভিন রাজ্যের প্রচুর শ্রমিক, দিনমজুর রয়েছে। তাদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যাও অনেক। এদের মধ্যে অনেকেই সুন্দরবন সহ পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য এলাকার বাসিন্দা। কয়েকদিন আগে কেরলের এরনাকুলামে প্রায় ৬-৭ হাজার বাঙালি শ্রমিক রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। তাদের একটাই দাবি, আমরা খাবার চাই না, কিচ্ছু চাই না, শুধু বাড়িতে ফিরতে চাই। তাদের আরও বক্তব্য, এই রোগ বিদেশ থেকে সেইসব লোকজনের মাধ্যমে এদেশে এসেছে যারা ফ্লাইটে যাতায়াত করেন। আমরা সামান্য মানুষ। আমাদের কাছে ভিন রাজ্য মানেই বিদেশ। আমাদের অবিলম্বে বাড়িতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক। ঘটনাস্থলে শীঘ্রই পৌঁছে যায় পুলিশ। ভাষাগত কারণে তারা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়েন। মালায়লম বেশ কঠিন ভাষা। তাই শ্রমিকরা ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে তাদের দাবির কথা পুলিশকে জানায়। পুলিশ তারপর স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, এখন আমরা সব রকম সাহায্যের জন্য প্রস্তুত। তবে অনুগ্রহ করে কেউ বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলবেন না। সেটা এখন অসম্ভব। পরে ঘটনাস্থল থেকে ওই বাঙালি শ্রমিকদের হঠিয়ে দেয় পুলিশ।
মুর্শিদাবাদের প্রচুর কেরলে রয়েছে। তারা বিভিন্ন কনস্ট্রাকশান সাইটে দিন মজুরের কাজ করেন। এই ধরণের দিন মজুররা প্রবল সমস্যায় রয়েছেন। তাদের সাপ্তাহিক পেমেন্ট হয়। এক সপ্তাহে যা রোজগার হয়েছিল, তা ইতিমধ্যে তারা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন তাদের হাতে টাকা প্রায় নেই। যেটুকু আছে, তা দ্রুত শেষ হচ্ছে। এরপর তারা কি করবেন, বুঝতে পারছেন না। সবার কাছে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, এটিএম কার্ড ইত্যাদি নেই।
লকডাউনের পর অনেক সহৃদয় ব্যক্তি আমাদের ইডলি-সাম্বারের পার্সেল দিচ্ছেন তবে সেটা দিনে একবার। তিন বেলা নয়। বাকি দুবেলার খাবার কিভাবে জোগাড় করা হবে, তা অনেকেই বুঝতে পারছেন না।
ট্রেন চললেই বাড়ি ফিরব। আর কেরলে থাকব না। এই পরিস্থিতিতে এখানে বেশিদিন থাকা যাবে না। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী দূর্গা পূজা পর্যন্ত থেকে যাওয়ার ভরসা পাচ্ছি না। কেরলে এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, কাল হঠাৎ করে বলতেই পারে, আরও দশ দিনের জন্য লকডাউন। তখন কি করব। বাড়ির লোক সবাই চিন্তিত। তারা বলছে বাড়িতে চলে যেতে। বাড়ি তৈরি করার জন্য আমি ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়েছি। তার মধ্যে অ্যাকসিডেন্টের কারণে এক বছর কর্মহীন ছিলাম। খুব ঝামেলায় রয়েছি। পকেটে পয়সা নেই। খুব খারাপ অবস্থা। পকেটে পয়সা না থাকলে, মাংস ভাত দিলেও ভালো লাগে না।