হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নেই, যখন বাঘ আর জঙ্গলে দেখাই যাবে না। বা বলা ভালো জঙ্গলে বাঘের থাকার জায়গাটাই থাকবে না। তখন কেবলমাত্র চিড়িয়াখানাতেই হয়তো দেখা যাবে এই ভয়ঙ্কর-সুন্দর প্রাণীকে। অনন্ত তেমনই ইঙ্গিত দিলেন গবেষকরা। তাদের আশঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার ফলে সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরবন থেকে বাঘ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হতে পারে। সম্প্রতি সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট নামক জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার রিপোর্টে এমনটাই দাবি করা হয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সুন্দরবন অবস্থিত। অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়া রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার কেবলমাত্র এখানকার ম্যানগ্রোভ অরণ্যেই দেখা যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সুন্দরবনের ভূমিভাগ মাত্র কয়েক ফুট উঁচুতে অবস্থিত। সুন্দরবনের ৭০ শতাংশ এলাকাই এইরকম নীচু। সমুদ্রের জলস্তর বাড়লে এই বিস্তীর্ণ এলাকা দ্রুত ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে বণ্যপ্রাণীদের বাসস্থান সঙ্কটের পাশাপাশি সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যেও বিঘ্ন ঘটবে। খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে।
বাঘের বাসস্থানের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব খতিয়ে দেখা হয় এই গবেষণায়। এছাড়া সামগ্রিক পরিস্থিতি আগাম অনুধাবনের জন্য ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) কর্তৃক উদ্ভব করা কম্পিউটার সিমিউলেশন ব্যবহার করা হয়।
নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০৭০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের বাসস্থানের জন্য উপযুক্ত কোনো জায়গা থাকবে না।


গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো সুন্দরবনের টিকে থাকায় নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে জলে লবণের পরিমাণ। অপর্যাপ্ত বৃষ্টি এবং সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির ফলে সুন্দরবনের নদীগুলির জলে লবণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। এরকম চলতে থাকলে সুন্দরী গাছ বাঁচতে পারবে না। আর এর ফলে ম্যানগ্রোভ অরণ্যও লুপ্ত হবে। বাসস্থান হারাবে সুন্দরবনের বাঘ।
গবেষণার সহলেখক তথা বাংলাদেশের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক শরিফ মুকুল সিএনএনকে বলেন, সুন্দরী গাছ এবং ম্যানগ্রোভের অনুপস্থিতিতে মিষ্টি জলও থাকবে না। এবং সমুদ্রের জলস্তর বাড়তে থাকলে বাংলার বাঘেদের বাঁচার কোনো রাস্তাই খোলা থাকবে না।
এছাড়া সুন্দরবনে প্রায় প্রতিবছর বিধ্বংসী বন্যার ফলেও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বাসস্থানের পরিমাণ ক্রমশ কমছে। তারা বাধ্য হয়ে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে প্রবেশ করবে। আগেও বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ করত, তবে এবার এই ধরণের ঘটনার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ বাঘ রয়েছে ভারতে। বাসস্থান এবং খাদ্যসঙ্কট ছাড়াও বেআইনী শিকারের কারণে বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। নব্বইয়ের দশকে যেখানে ভারতে মোট বাঘের আনুমানিক সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০,০০০, সেটা এখন কমে হয়েছে মাত্র ৪,০০০। বাঘ সংরক্ষণে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের জেরে সম্প্রতি বাঘের সংখ্যা ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাষ্ট্রসংঘের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, সমগ্র বিশ্বে বাস্তুতন্ত্রে ভয়ানক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিলোপের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে দশ লক্ষ উদ্ভিদ ও প্রাণী। প্রবাল প্রাচীর এবং যে সমস্ত এলাকায় প্রায়শই বন্যা হয়, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় সেগুলি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চলেছে।