বিশ্বজিৎ মান্না
আবহায়া দপ্তর বলছে, শীত এসে গিয়েছে। সম্ভবত কয়েকদিনে ঠাণ্ডার তীব্রতা বাড়বে। তবে গ্রামে যারা থাকেন, তারা জানেন, শীত ইতিমধ্যে সেখানে এসে গিয়েছে। শহরে দূষণের কারণে সেটা বোঝা যায় না। গ্রামে এখন রীতিমতো শীতের মেজাজ। ভোরবেলা কুয়াশা।
আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কাকদ্বীপ মহকুমার পাথরপ্রতিমা ব্লকে। আমার গ্রামের নাম দক্ষিণ লক্ষ্মী নারায়ণপুর। বুড়ার বাঁধার কাছে আমার বাড়ি। একেবারে রাস্তার ধারে। বাড়ির সামনের ইঁটের রাস্তাটাই ছিল তখন গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র লাইফ লাইন। রাস্তার একপ্রান্তে পাথরপ্রতিমা বাজার, আর অন্যপ্রান্তে ভগবতপুর কুমীর প্রকল্প। সরু ইঁটের রাস্তা দিয়েই ভ্যান, সাইকেলে করে মানুষ তাদের গন্তব্যে যেতেন। বিশেষত বর্ষাকালে যখন গ্রামের অন্যন্য মাটির রাস্তায় দলা পাকানো কাদা দেখা যেত, তখন এই ইঁটের রাস্তায় ভিড় বাড়ত। সোমবার ছিল পাথরপ্রতিমা বাজারের হাটবার। ওই দিনও রাস্তায় ভিড় অনেক বেশি থাকত।
এখন অবশ্য সময় পাল্টেছে। সেই ইঁটের রাস্তাটা আজও আছে। কিন্তু সেখান দিয়ে আর বেশি মানুষকে যাতায়াত করতে দেখা যায় না। কারণ গ্রামে বিকল্প রাস্তা তৈরি হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার অধীনে গঙ্গাধরপুর থেকে ভগবতপুর কুমীর প্রকল্প পর্যন্ত তৈরি হয়েছে পিচের রাস্তা। সেটাই এখন গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছে।
শীতকাল এলেই গ্রামের ছেলেরা ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠত। নানা টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হত। ফসল উঠে যাওয়ার পর এবড়োখেবড়ো ধান জমিতেই চলত খেলা। কোথাও প্লাস্টিক বলে, কোথাও টেনিস বলে। আমার বাড়ির সামনে যে জমি ছিল, সেখানে মূলত আমি নিজের উদ্যোগে প্রত্যেক বছর পিচ বানাতাম। কোদাল দিয়ে এবড়োখেবড়ো মাটি সমান করতাম। আমার প্রাইমারি স্কুলের নাম ছিল মাঝেরপাড়া অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। তারপর ক্লাস ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত পড়েছি যুধিষ্ঠীর বিদ্যাপীঠে। স্কুল থেকে ফিরে কোনো রকমে নাকে মুখে গুঁজে দৌড়োতাম মাঠে। বাবা খুব ছোটোবেলায় কলকাতা থেকে একটা ব্যাট কিনে দিয়েছিল। সেকেন্ড হ্যান্ড বোধহয়। হ্যান্ডেলটা নড়বড়ে ছিল। গ্রিপ ধরা যেত না ঠিক ঠাক। তাই নিয়েই মাঠে নামতাম। এবং পাড়ায় সম্ভবত একমাত্র আমারই ছিল স্টিকার লাগানো ব্যাট। সেই জন্য অনেকে আমার সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করত! যাতে ব্যাট করার সুযোগটা আগে পাওয়া যায়। ধানজমিতে ক্রিকেট খেলার একটা বড় অসুবিধে হল ডাইভ দেওয়া যায় না। এবং ডাইভ দিলে চোট, হাত-পা ছড়ে যাওয়া অবধারিত। বাড়িতে অনেক সময় চোট-আঘাতের কথা বলতাম না। কারণ বললেই ঠাকুমার বকা জুটত। সঙ্গে দু-চার ঘা ফ্রি!
প্রত্যেক বছর ক্রিকেট ছাড়া আরও একটি কারণে শীতের জন্য অপেক্ষা করতাম। সেটা হল পিঠে। আমাদের দুটো পুকুর ছিল। পুকুরের পাশেই দুফালি জমি। বিঘা খানেক হবে বোধহয়। তাতে যা ধান হত, তাতে আমাদের মোটামুটি মাস ছয়েক চলত। বাকি ছ মাসের জন্য রেশনের মোটা চাল ছাড়াও চড়া দরে দোকান থেকে চাল কিনতে হত। যাইহোক, শীতের ধান কাটার পর উঠোনে রাখা হত। যাকে বলে ধানের গাদা। সেই ধান পরে ঝাড়াই, বাছাই, সিদ্ধ, শুকনো করার পর নিয়ে যাওয়া হত ঢেকিতে। পরে ঢেকির জায়গা নিয়েছিল চালকল। নতুন চালের ভাত যেদিন বাড়িতে হত সেদিন ঠাকুমা অন্যন্যা নানা পদেরও আয়োজন করতেন। আগের রাত থেকে চাল ভিজিয়ে রাখা হত। সকলা হতেই ঠাকুমা শিল-নোড়া দিতে চাল বাটতে শুরু করতেন। চালের গুঁড়ো দিয়ে নানা পিঠে হত। তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল পাটি সাপটা। শীতের রাতে গরম গরম পাটি সাপটা খাওয়ার মজাই আলাদা। আমি সন্ধে থেকে উনুনের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতাম! কখন প্রথম পাটি সাপটা টা কড়াই থেকে নামবে আর আমি মুখে পুরব!