দ্য হাঙ্গরি টাইড হল বাঙালি লেখক অমিতাভ ঘোষের চতুর্থ ফিকশন উপন্যাস। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম পিয়ালী রায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় হয়েছেন। তিনি একজন সিটোলজিস্ট (cetologist)। অর্থাৎ তিমি এবং ডলফিন বিশেষজ্ঞ। সুন্দরবনে ডলফিনের উপর সমীক্ষা চালানোর জন্য তিনি সুন্দরবনে আসেন।
জন্ম থেকেই মার্কিন মুলুকে থাকলেও পিয়া তার শিকড় সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনা করার ফলে তার কথাবার্তা, আদবকায়দা সবই পাশ্চাত্যের আর পাঁচটা লোকের মতো। তিনি আদতে বাঙালি পরিবারের তবে বাংলা জানেন না। প্রবাসে থাকায় বাংলা শেখা হয়ে ওঠেনি। তবে নিজের কাজ সম্পর্কে তার প্রবল আত্মবিশ্বাস রয়েছে। পিয়া স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। সুন্দরবনে গিয়ে একটি বিশেষ ঘটনার সম্মুখীন হন পিয়া। একজনকে তিনি নদীতে ডুবে যেতে দেখেন। এরপর সুন্দরবনে নিজের সমীক্ষার কাজ করার সময় এক মাঝিকে তিনি নিজের গাইড হিসেবে বেছে নেন।


সুন্দরবনে যাওয়ার সময় ঘটনাচক্রে এক তরুণ বাঙালি কানাইয়ের সাথে পিয়ার দেখা হয়। সুন্দরবনের ইতিহাস, লোকগাথা, বাস্তুতন্ত্র, মাইগ্রেশন সহ নানা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। হিন্দু মিথ অনুযায়ী, সৃষ্টি এবং ধ্বংসের দেবতা শিবের জটা থেকে গঙ্গা নিজেকে উন্মুক্ত করেছে বঙ্গোপসাগরের কাছে, যাতে সুন্দরবন তৈরি হয়। কয়েক হাজার হেক্টর এলাকা জুড়ে অবস্থিত সুন্দরবনের অনেক অংশ জোয়ারে ডুবে যায়। আবার ভাটার সময় সেগুলি দৃশ্যামন হয়। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে, শব্দের জাদুতে এই দৃশ্যগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন অমিতাভ ঘোষ। তিনি ফ্যান্টাসি আর বাস্তবের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন তৈরি করেছেন: “কোনো সময়েই এলাকায় তাদের প্রতিকূলতা, চালাকি, সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা, এটিকে ধ্বংস এবং বিতাড়িত করা সম্পর্কে মানুষের সন্দেহ থাকবে না। প্রত্যেক বছর বহু মানুষের মৃত্যু হয় বাঘ, সাপ এবং কুমীরের আক্রমণে।”
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির মতো হাঙ্গরি টাইডেও আমরা চিরাচররিত বাংলা ভাষার ঐতিহ্য ধরে রাখার একটা প্রচেষ্টা দেখতে পাই। বইটা পড়ার সময় তা অনুভব করতে পাঠকের কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পরিচিত শব্দগুলির সাথে কোনো অসুবিধা হয় না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বইটি যেহেতু বাংলায় নয়, ইংরেজিতে লেখা হয়েছে, তাই চিরাচরিত বাংলা শব্দ অনেক সময় ইংরেজি পাঠকদের কাছে অপরিচিত মনে হতে পারে। সেই জন্য অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শব্দের প্রয়োগ করেছেন অমিতাভ ঘোষ। যেমন তিনি গামছা শব্দটি ব্যবহারের আগে ৪০০ শব্দ খরচ করে তুলে ধরেছেন যে কেন তিনি গামছার সমতুল কোনো ইংরেজি শব্দের বদলে হুবহু ওই বাংলা শব্দ ব্যবহার করেছেন তার ইংরেজি ভাষায় লেখা উপন্যাসে। ইংরেজি পাঠকদের যাতে এই চিরাচরিত বাংলা শব্দগুলি বুঝতে অসুবিধা না হয়, সেই উপন্যাসের অনেক জায়গায় শব্দগুলির অনুবাদও তিনি করেছেন। উপন্যাসের বিভিন্নি অংশে তিনি অনেক চলতি বাংলা শব্দ প্রয়োগ করেছেন।
মরিচঝাপি গণহত্যার প্রসঙ্গটিও উঠে এসেছে এই বইতে। অমিতাভ ঘোষ আর যে কাজটি দক্ষতার সাথে করেছেন তা হল দুই প্রজন্মকে তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে বামপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী চরিত্র নির্মলের কথা বলা যায়। তিনি এমন একটা পৃথিবীতে বিশ্বাস করেন যেখানে মানুষ সকালে কৃষক, দুপুরে কবি এবং সন্ধ্যায় কাঠমিস্ত্রি হতে পারে। অনিতা দেশাই এবং আর কে নারায়ণের তুলনায় অদ্ভুতভাবে পোস্ট কোলোনিয়াল লেখক অমিতাভ ঘোষ মনে করেন স্থানীয় ভাষা এবং সংস্কৃতি লেখায় ফুটে ওঠা অত্যন্ত জরুরি। তাতে বিষয়টি আরও বাস্তবধর্মী হয়ে ওঠে।