বিশ্বজিৎ মান্না
এই তো দিন কয়েক আগের কথা। বেশ হাঁসিখুশি ছিলেন সুন্দরবনের কাকদ্বীপ এলাকার বাসিন্দা প্রণব বিশ্বাস। একমাত্র পুত্র পেশায় ভিনরাজ্যের শ্রমিক সম্প্রতি লকডাউনের বাধা পেরিয়ে মহারাষ্ট্র থেকে বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। বাড়ির সবাই ভেবেছিলেন, এ যাত্রায় তারা বড় বিপদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছেন। তার পুত্র ঠিক করেছিলেন, এবার আর পেটের ভাত জোগাড় করতে ভিন রাজ্যে যাবেন না। নিজের গ্রামেই থাকবেন। একটা ছোটো ডিঙি নৌকার ব্যবস্থা করছিলেন, যাতে করে মাছ ধরার ব্যবস্থা করবেন। মাছের কারবার করে টাকা রোজগার করবেন।
তবে গত বুধবারের বিধ্বংসী সাইক্লোন আম্ফানের জেরে বছর ৫০-এর প্রণবের সমস্ত পরিকল্পনা আপাতত বিশ বাঁও জলে। এই ঝড়ে তার বাড়ি, সম্পদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। যেটুকু সঞ্চয় ছিল, তাও এখন আর হাতে নেই। প্রণববাবু বলেন, লকডাউন একবার উঠলে ফের একবার পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মহারাষ্ট্রেই শ্রমিকের কাজ করতে যাবেন। তার সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। ছয় জনের পরিবারের প্রত্যেকের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিতে হলে এটাই একমাত্র ভরসা। প্রণববাবুর কথায়, ২০০৯ সালে সাইক্লোন আয়লার পর আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করার জন্য নাসিকে গিয়েছিলাম। তবে আমার বয়স হচ্ছে। আমার জায়গায় কাজ করার দায়িত্ব নেয় আমার ছেলে। ও সেখানে অন্তত চার বছর ধরে কাজ করছে। আমি হাজার দশেক টাকা সঞ্চয় করেছিলাম। ছেলে বাড়িতে ফিরে আসার পর সেই টাকা দিয়ে একটা মাছের ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা ছিল। তবে এখন আমার সঞ্চয়, বাড়ি, গৃহপালিত পশু সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। এদিকে আমার দুই মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। তাদের বিয়ে দিতে হবে। টাকা প্রয়োজন।


প্রণববাবু জানিয়েছেন, শ্রমিক সরবরাহকারী এজেন্সির সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। লকডাউন উঠে গেলে যাতে কাজ পাওয়া যায়, তিনি তাদের সেই অনুরোধ করেছেন। এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ার মতো সমস্যায় ইতিমধ্যে সুন্দরবনের জেরবার অবস্থা। সাইক্লোন আম্ফান যেন সেই কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো সমস্যাটাকে আরও জটিল করে তুলল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এবার সুন্দরবনের মানুষরা আরও বেশি মাত্রায় ভিনরাজ্যে কাজের সন্ধানে যাবেন। কারণ আক্ষরিক অর্থে এখন সুন্দরবনে তাদের পেট চালানোর মতো কোনো উপায় নেই। ইচ্ছে না থাকলেও তাদের ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজে যেতেই হবে। বিশেষত আম্ফানের পর এই প্রবণতা আরও বাড়বে। সুন্দরবন বিষয়ক মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা স্বীকার করেছেন, সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দ্য হিন্দু পত্রিকার একটি রিপোর্টে প্রকাশিত তার মন্তব্য, এলাকায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আবার শূন্য থেকে সবকিছু শুরু করতে হবে।
ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার নদীবাঁধগুলি সুপার সাইক্লোন আম্ফানের জেরে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিঘার পর বিঘা জমি এখন নোনা জলের তলায়। সেখানে কবে ফের স্বাভাবিক কৃষিকাজ শুরু করা যাবে, তা কেউ জানেন না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওশিয়ানোগ্রাফিক সায়েন্সেস-এর ডিরেক্টর সুগত হাজরা বলেন, পরিকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার ফলে সুন্দরবনের মানুষের জীবিকা ব্যহত হবে। আগামী দিনগুলিতে সুন্দরবন এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ মাইগ্রেশন চোখে পড়বে। সাইক্লোন আয়লার পর যেটুকু পুনঃনির্মাণ করা হয়েছিল, সাইক্লোন আম্ফানে তা ফের নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সুন্দরবন এলাকার পুরুষদের এই ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়ার প্রবণতার পিছনে মূল কারণ হল স্থানীয় স্তরে কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পাওয়া বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। বিগত বছরগুলিতে এই ছবি দেখা গিয়েছে। আগামী দিনেও তা বদলানোর কোনো সম্ভাবনা নেই।


উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অবস্থিত সুন্দরবনের প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ কৃষি, মৎসচাষ বা মাছ ধরা এবং পর্যটনের উপর নির্ভর করেন। এছাড়া এলাকাগুলির একটা বড় অংশের মানুষ ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে যান। ২০০৯ সালে আয়লার কারণে নদীবাঁধ ভেঙে নোনা জল ধানক্ষেতে প্রবেশ করে। তারপরও জীবিকার সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। তারপর থেকেই ভারতের একপ্রকার লেবার ফ্যাক্টরি হয়ে ওঠে সুন্দরবন। শামিমা মণ্ডল যেমন বলেন, আগে গ্রামের পুরুষরা এখানেই কাজ করতেন। তবে আয়লার পর আমাদের রুজিরুটিতে টান পড়ে। তাই কাজের সন্ধানে তাদের ভিনরাজ্যে যেতে হয়। এই সাইক্লোনে ফের আমরা মাথা গোঁজার ঠাঁই হারালাম। জানি না কি হবে।
মূল প্রতিবেদনটি দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।