গোসাবা থেকে ফিরে লিখেছেন সাগ্নিক চৌধুরী
‘পালে বাঘ পড়েছে’, বাঙালির এক অতি পরিচিত প্রবাদ কিন্তু কখনও এর মর্মার্থ উপলব্ধি করেছেন? আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার! ঠিক এটাই বলছি। ধরুন আপনি ঘুমিয়ে আছেন কাঁথা মুড়ি দিয়ে। এমন সময় আধ ঘুম চোখে দেখলেন, আপনার পাশেই বিরাজমান বাঘ মশাই! তখন যে আপনার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবেই, তার গ্যারান্টি নতুন পাখা কেনার থেকেও বেশি।
বিষয়টা আপনার কাছে হয়ত খুবই রোমাঞ্চকর বা টানটান উত্তেজনার মনে হতে পারে কিন্তু যে সব মানুষদের সাথে এই সব ঘটনা রোজকার ডাল ভাতের মত হয়ে গেছে তাদের, মশাই আপনার পাতের এই বিরিয়ানিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এটুকু আমি হলফ করে বলতে পারি।
আমরা গেছিলাম চেনা সুন্দরবনের এক অচেনা রূপ খুঁজতে। বেলা ১২টার নাগাদ যখন গদখালির ফেরিঘাটে পৌঁছলাম, তখন সেখানে প্রচুর বাস গাড়ি আর মানুষের সমাগম সবাই ঘুরতে এসেছে করোনার করাল ছায়া থেকে অনেকদূরে নদীবক্ষে একটু সময় কাটানো, প্রিয়জনদের সাথে এই মাত্র উদ্দেশ্য। যাইহোক আমরা আমরা দুটো নৌকা পেরিয়ে এমন এক দ্বীপে এলাম যেখানে পর্যটকের বিশেষ একটা সমাগম নেই কারণ ” সেখানে তেমন কিছু দেখার জিনিস নেই “। দ্বীপের নাম বালি। ইন্দোনেশিয়া বা হাওড়ার বালি নয়, সুন্দরবনেরই এই দ্বীপের নাম বালি! প্রশাসনের খাতায় বালি-১ গ্রাম হিসাবে নথিভুক্ত। আর সব থেকে বড় কথা হল লোকের মুখে মুখে প্রচারিত সেখানে নাকি শীতকালে বাঘমশাইদের আগমন হয়, তাই ভ্রমণ রসিক বাঙালি এ পথ মাড়ায় না কারণ পাছে বাঘ কাকু এসে ‘হ্যালো হাউ আর ইউ’ বলে যায়। আসলে আমরা যতই মুখে মারিতং জগত হই না কেন, বাঘকে আমরা চিড়িয়াখানার মোটা তিন স্তরের তারের জালে বন্ধী হয়েই দেখতে ভালবাসি, দূর থেকে তাকে টোন টিটকিরি মারতেই বেশি অভস্ত্য। চেনা গণ্ডির বাইরে এসব ঝুঁকি পোহাতে একদম গররাজি। কিন্তু এই মানুষগুলো দিনে রাতে শয়নে জাগরণে জানে তাদের এখানে বাঁচতে গেলে লড়াই করে বাঁচতে হবে। আর এখানে প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ নয় মানুষের দ্বিগুণ ওজনের অতীব হিংস্র এবং চতুর দ্য রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।
যাই হোক বিষয়ে ফেরা যাক, এখানে এসে বিভিন্ন লোকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে মাইল চার বা পাঁচেকের দূরত্বতে ঘন জঙ্গল সেখানে এই দিন পনেরো আগে একজন কাঠ আনতে বনে গেছিলেন কিন্তু কয়েকদিন আগে ওনার ছেঁড়া জামা এবং মুণ্ডুহীন বডি পাওয়া গেছে, যারা দেখতে পেয়ে ছিলেন তারা তুলে এনেছেন। এ সব নাকি ওখানে আখছারই হয়ে থাকে, এখানকার মানুষদের কাছে এসব খুবই কমন ব্যাপার। একদিকে চরম দারিদ্র, অন্যদিকে শিক্ষার অভাব তাঁর সঙ্গে এই অতীব জন্তুর সাথে প্রতি নিয়ত লড়াই – এদের কাছে যেন গা সয়া হয়ে গেছে। আর আপনি মশাই ভিড় বাসে ট্রেনে লড়াই করে অফিস যাওয়া আসা করে ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে বলছেন, ‘এই হাড় ভাঙ্গা খাটুনি আর তো সয় না’।
যদিও সমস্যা আমাদের সবার জীবনেই আছে প্রতিদিন আমাদের মাস্ক স্যানিটাইজার নিয়ে লড়তে হচ্ছে, ঘামে ভিজে অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে, সবার লড়াইটা নিজের মতন হয় কারও সাথে অন্য কারও তুলনা চলে না। তবুও একটু সময় পেলে ভেবে দেখবেন এসব মানুষগুলোর কথা যারা দিনে ২০০ টাকা বা তারও কম রোজে মাঠে চাষ করে, দুটো পয়সা বেশি ইনকামের জন্য চলে যান ভিন্নরাজ্যে। আম্ফান বা বুলবুল যাদের মাথার ছাদ কেড়ে নেয়, জঙ্গলে মধু আনতে গিয়ে বাঘের মুখে পড়েন, রাতবিরাতে বাঘ মশাই তাদের ঘরে ঢুকে পড়েন, তাদের জীবনের সাথে আমাদের প্রাত্যহিক শাহুরিক জীবনযাপনের কি তুলনা চলে?