বিশ্বজিৎ মান্না
গড়িয়ায় থার্টিন্থ ফ্লোরের বারান্দাটা কি এখন আমায় চিনতে পারবে! অনেক দিন দেখিনি। যেমন দেখিনি টালিগঞ্জে আমার প্রিয় আড্ডার ঠেক, আমার প্রিয় কফিহাউজ, চাঁদনি চকের সস্তা বার, বিধান মার্কেট, নেতাজী কেবিন, বিশুর চায়ের দোকান, বিট্টুর ছাদ, স্বর্ণদার গান, বিশুর হাতের কষা মাংস।
জানি সবই আপেক্ষিক, এই জীবন, এই স্মৃতি, এই আমি। আমার মধ্যে যে আমি বাস করে, তাকে নিয়ে আমি বড্ড সমস্যায় পড়েছি। সে বার বার বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তা কি সম্ভব? তাহলে তো অনেক কিছুই বদলে যাবে। এই তো কয়েকদিন আগে ডুয়ার্স গেলাম। চালসা, মেটেলিতে ঘুরলাম। মা চলে যাওয়ার পর প্রথমবার বাড়ির বাইরে পা রাখলাম। সেবকের কাছে তিস্তায় পা ডুবিয়ে বসেছিলাম। জল দেখছিলাম। একটা অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছিল। বাইরে থেকে দেখলে কিছু বোঝা যাবে না। কিন্তু আমার ভিতরে একটা ঝড় চলছে। অনেক কিছু হিসেব মেলাতে পারছিলাম। তিস্তার জলে পা ডুবিয়ে সেসব ভাবছিলাম। আমার বয়স কত? কথায় বলে জীবন নাকি চল্লিশের পর শুরু হয়। আমার বোধহয় তার অনেক আগেই শুরু হয়েছে।
জীবনে আমি থিতু হতে পারলাম না। শিলিগুড়ি বয়েজ স্কুলের পাঠ চুকিয়ে যেই কলকাতায় গেলাম, প্রেসিডেন্সিতে পা রাখলাম, সেই সময় থেকেই এটা শুরু হয়েছে। প্রথমে চেষ্টা করিনি। সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়েছি। প্রেম করেছি, নেশা করেছি, বুঁদ হয়ে থেকেছি। থিতু হওয়ার প্রয়োজন মনে হয়নি। কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর থেকে শুধু মনে হচ্ছে, আমি বোধহয় কোথাও একটা ভুল করেছি। আমার আরও দায়িত্ববান হওয়া প্রয়োজন ছিল। একটা চাকরির পর আর একটা চাকরি, কোনো কিছুতেই স্থায়ী হতে পারলাম না। ভিলাইয়ের স্কুলে চাকরিটা পাওয়ার পর মনে হয়েছিল, এবার বোধহয় অস্থিরতা কমবে। তাতে অনেকটা সফলও হয়েছিলাম। পুরানো ছন্দে ফিরছিলাম। মেয়েটার সঙ্গে দেখা করলাম। ক্রিসমাসে। কত খুশি আমাকে এতদিন পরে দেখে। কত ছবি আঁকল। ও নাকি বড় হয়ে একজন আর্টিস্ট হতে চায়। আমার মতো?
অবশ্য আজকাল আর সেসব হয় না। মা হঠাৎ চলে যাওয়ার পর চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। শিলিগুড়ি ভীষণভাবে ডাকছিল। এই বাড়ির প্রতিটা কোণা, প্রতিটা ইঁট আমায় কাছে ডাকছিল। বাবার কমরেড জীবন থেকে দেখেছি কত লোকের আনাগোনা ছিল এই বাড়িতে। আজ সব কেমন যেন নিঃশ্চুপ। একদম। কোথাও কেউ নেই। পুরো বাড়িটাকেই একটা অন্ধকার গ্রাস করেছে। মাকে শুধু ছাদে দু একবার দেখতে পাই। আর কিছু দেখি না। কলকাতা, ভিলাই, শিলিগুড়ি….এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল? আমি তো এরকম দেখিনি। বাড়ির এত সদস্য। তবুও এখানে কেউ নেই। একজন তো আর ফিরবে না। চলে গিয়েছে না ফেরার দেশে। বাবা কি জানে এখন আমি কি করছি? হাঁটুর বয়সী মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছি বলে অনেক কথা শুনছি। প্রেম করার কি কোনো বয়স আছে? কিন্তু এটাও বোধহয় আপেক্ষিক। কারণ আমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা আমিটাকে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছি না। একটু গলা ছেড়ে গান গাইব এখন। কবীরের লাইনগুলি বোধহয় আমার জন্যই লেখা, “হোঁশিয়ার রেহনা নগর মে চোর আওয়েগা, চোর আওয়েগা রে একদিন, যম আওয়েগা…..” (ক্রমশ)