প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
“উহ বাত সারে ফসানে মে
জিসকা জিকর কহী না থা” – ফয়েজ আহমেদ
পাঁচের দশকের শেষাংশ। শীতকাল। লাহোর ফোর্ট জেল। ভোরের কুয়াশা ঠেলে ধীরে ধীরে খুলে গেল ভারি লোহার দরজা। জেলের প্রধান ফটক। সরে দাঁড়ায় সান্ত্রীরা। ছুটে বেরিয়ে আসে একটি ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা। সেই টাঙ্গায় বসে এক মধ্যবয়সী রাগী মানুষ। একজন কবি। একজন বিদ্রোহী। একজন অপরাধী, যার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ। তাঁর নাম ফয়েজ আহমেদ। তাকে ঘিরে কয়েকজন সশস্ত্র রক্ষী। মানুষটি অসুস্থ। জেলখানার দমবন্ধকর পরিবেশে শরীরে বাসা বেঁধেছে রোগ, ক্ষয়ে গেছে দাঁত, ঘনঘন জ্বর। চিকিৎসার প্রয়োজন। অসুস্থ মানুষটিকে নিয়ে পুলিশ হাসপাতালের দিকে সপাটে ছুটে চলে গাড়ি…
ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় উড়ছে কবির চুল। তিনি বুকে চেপে ধরে আছেন তার লেখার ডায়েরি। তার হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ি। শাসক দলের কাছে তিনি একজন অপরাধী। তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছে পাক প্রিমিয়ার জেনারেল আয়ুব খানের সরকার। রাওয়ালপিণ্ডি ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম দোষী তিনি। জেলের রুক্ষ আবহাওয়ায় ক্ষয় ধরেছে তাঁর শরীরে। দাঁতে অসহ্য যন্ত্রণা। তাও লেখা ছেড়ে থাকেননি এক মুহুর্ত। পুলিশ তাকে মেডিকেল ইউনিটে নিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য। আর কবি? তিনি তখন শান্ত নরম চোখে বাজার-সড়ক, ইদগাহ, সরাই, লাহোরের গলিঘুঁজি দেখতে দেখতে চলেছেন। এতদিন ছোট্ট, অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই ‘সেলে’ তাঁর রাত কেটেছে, যেখানে আলো ঢুকতেও নারাজ। এই বন্দিদশা থেকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি…না হয় ডাক্তারের কাছে যাওয়া, তাই বা কম কী?
একটু একটু করে ফুটেছে আলো। রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে মানুষ। টাঙা প্রবেশ করে বাজারে। ততক্ষণে শহরের লোক দেখতে পেয়ে গেছে সেই গাড়িটিকে…দেখতে পেয়েছে তারা আপাদমস্তক শিকলে বন্দী কবিকে। এ কি দশা হয়েছে তাঁর? সবাই জানে তাঁর অপরাধ কি! অপরাধ একটাই – তিনি রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন ‘নজম’র মাধ্যমে। তার লেখনি ঝড় তুলেছিল তামাম পাকিস্তানে। রাষ্ট্র অস্বস্তিতে পড়ে। জারি হয় মার্শাল ল। গ্রেফতার হন ফয়েজ। টানা চার বছর জেল খেটেছিলেন তিনি। এরই মধ্যে জেলে থাকাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাতেও মন গলেনি আয়ুব খান সরকারের। জরুরি চিকিৎসার আর্জি খারিজ হয় বহুবার। একদিন মাথা ঘুরে জেলেই পড়ে গিয়ে ছিলেন ফয়েজ। বাধ্য হয়ে তাঁকে মেডিকেল ইউনিটে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাদের ভয়, এমন ‘আগুনখোর’ অদম্য মানুষ, যদি নাগাল গলে পালিয়ে যান? এতএব পরাও শিকল, লাগাও হাতকড়া, পায়ে জড়াও বেড়ি। সেই অবস্থাতেও কবির মুখে হাসি। তিনি কোন প্রতিবাদ করেননি। নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যেই ঘোড়ার গাড়িতে চেপে রওনা হয়েছিলেন জেলখানার মেডিকেল ইউনিটের উদ্দেশ্যে।
কবিকে টাঙায় শিকল পরে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে শহরের মানুষ। কেউ এগিয়ে দেন ফুল, কেউ কলম-কাগজ, কেউ ছেটান আতর। তাঁর এহেন দুর্দশায় শহরবাসীর চোখেও জল। কবিকে ডাক্তারখানা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে টাঙার পিছন পিছন ছুটে চলে জনতা। রক্ষীরা তাঁদের সরানোর চেষ্টা করে। পারে না। আর কবি? সেই দিব্যোন্মাদ মানুষটি তখন এই দৃশ্য দেখে আপনমনে উচ্চারণ করছেন তার লেখা ‘নজম’। তার সঙ্গে গলা মেলায় সহস্র মানুষ।
“আজ বাজার মে পা-বাজোলা চলো
চশম-এ-নম, জান-এ-শরীদা কাফি নহী
তহমদে ইশক-এ-পশিদা কাফি নহী
আজ বাজার মে পা-বাজোলা চলো।”
[চলো, শিকল পায়েই আজ বাজার যাই
অশ্রুসিক্ত চোখ, অশান্ত হৃদয় যথেষ্ট নয়
গহনান্তরে নিবদ্ধ ভালোবাসাও নয় যথেষ্ট
চলো, এই বেড়ি বাঁধা পায়েই বাজার যাই]
এভাবেও একটা গান লেখা হয়েছিল পৃথিবীর বুকে। এভাবেও বন্দীদশা ভেদ করে বেরিয়ে এসেছিল কবিতার আলো। এভাবেই শাসকের রক্তচক্ষু আর প্রহরীদের অতন্দ্র প্রহরা পেরিয়ে গান, গান হয়ে উঠেছিল…সাধারণ মানুষের সমবেত কলস্বরে। ফয়েজ আহমেদ এমনই এক উন্মাদনার নাম। পরে এক স্বাক্ষাতকারে ফয়েজ জানিয়েছিলেন – “জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া নয়। সেদিন লাহোরের রাস্তায় শতাধিক মানুষের সেই অকৃত্রিম ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার আমার জীবনে।”
ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের (১৯১১-১৯৮৪) সেই ‘নজম’ ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। মানুষের মুখে ফিরতো তার সেই লেখা। ‘জেলখানার গান’ নামেই যা বেশি পরিচিত। ফয়েজের এই রচনা যখন ধীরে ধীরে দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে এই দেশে, নায়রা নূর (১৯৫০-) তখন নিতান্তই শিশু। দুটি ভিন্ন দেশে, ভিন্ন সময়ে বেড়ে ওঠা দুই ব্যক্তিত্বকে মিলিয়ে দিয়েছিল এই কালজয়ী রচনাটি। ফয়েজের এই ‘নজম’-র সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন নায়রা। অথচ দুই দেশের মানুষ কতটাই বা মনে রেখেছে এই অসামান্যা বিদূষী মহিলাটিকে।
অসমের গুয়াহাটিতে জন্ম নায়রার। বাবা ছিলেন মহম্মদ আলী জিন্নাহ’র গুণগ্রাহী, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের সক্রিয় সদস্য। ১৯৫৮ সালে গুয়াহাটি ছেড়ে নায়রা’র পরিবার পাড়ি দেয় পাকিস্তানে। শুরু হয় নতুন জীবন। পড়াশোনার পাশাপাশি গান ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় আশ্রয়। নূরজাহান ও কানন বালা ছিলেন তাঁর আদর্শ। কমলা ঝরিয়া ও আখতারি বাঈয়ের বিশেষ ভক্ত নায়রা খুব অল্প বয়সেই শাস্ত্রীয়, লঘু শাস্ত্রীয় ও গজলের ব্যুৎপত্তি হাসিল করেন। সে অর্থে তথাকথিত গান না শিখলেও বা গানের কোন প্রশিক্ষণ না থাকলেও অবলীলায় তিনি গেয়ে ফেলেছেন বহু গান। করাচিতে শুরু হয় তাঁর গানের তালিম। তাঁর মায়ের কাছে। কালক্রমে তাঁর কন্ঠের জাদু ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সে সময় পাকিস্তান জুড়ে অখণ্ড সুরের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন নূরজাহান, ফরিদা খানুম, ইকবাল বানুর মত গায়িকারা। ঢুকে পড়েছেন সুরাইয়া, বেগম আখতার বা লতা মঙ্গেশকরের মত সরস্বতীর মানসকন্যারাও। সেই সময়ে একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠে নায়রা। কিন্তু এই বিখ্যাত সব প্রতিভার মাঝে হারিয়ে যাননি তিনি। রেডিও পাকিস্তানে গান গেয়ে শুরু হয় তার পথ চলা। এরপর ‘৭১ সালে বিভিন্ন পাকিস্তানি টেলি সোপ ও ‘৭৩-এ শুরু হয় ‘ললিউডে’ তার প্রথম প্লেব্যাক। ছবির নাম ‘ঘরানা’। প্রথম ছবিতেই তার মুনশিয়ানার নিদর্শন। দুর্দান্ত হিট হয় সেই ছায়াছবির গান। নিমেষে সারা দেশের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন নায়রা। দেশের মানুষ জানতে পারে এরমধ্যেই নায়রা তিন তিনটি গোল্ড মেডেল জিতে নিয়েছে অল পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্সে। পরবর্তী কালে একশোরও বেশি সিনেমায় প্লে ব্যাক করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর নাম আজও সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে ফয়েজ আহমেদের সঙ্গে। আশির দশকের প্রথমভাগে প্রকাশিত হয় ফয়েজ আহমেদের গজল নিয়ে নায়রার প্রথম রেকর্ড। সুরের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বিশেষ করে নায়রা নূরের গাওয়া – “আজ বাজার মে পা-বজোলা চলো”। রচিত হল ইতিহাস। লাখো লাখো রেকর্ড বিক্রি হয়েছে শুধু এই একটি গান শোনার জন্য। বহু অনুষ্ঠানে ডাক পেয়েছিলেন নায়রা নূর। তিনি তখন গোটা পাকিস্তানের ‘হার্টথ্রব’। অথচ কখনো অহংকার তাঁকে গ্রাস করেনি। স্কুলপড়ুয়াদের মত লাজুক, মার্জিত, অমায়িক ব্যবহার সর্বদা ছিল নায়রা নূরের সঙ্গী। আজও ফয়েজের লেখা সেই ‘জেলখানার গান’ মানেই নায়রা নূর। দুজনে দুজনের পরিপূরক, অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এই দেশেও পড়েছিল সেই গানের প্রভাব। অনিতা দেশাইর সুবিখ্যাত কাহিনি অবলম্বনে বৃদ্ধ শশী কাপুর, ওম পুরি, শাবানা আজমিকে নিয়ে ১৯৯৩ সালে নির্মিত হয় ইসমাইল মার্চেন্টের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ‘ইন কাস্টডি’ সিনেমাটি। আলাদা করে নজর কেড়েছিল এই সিনেমার সঙ্গীত। পরিচালনায় ছিলেন বিখ্যাত তবলাবাদক উস্তাদ জাকির হোসেন ও সারেঙ্গী সম্রাট উস্তাদ সুলতান খান। ছবির শেষ দৃশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের সেই অমর সৃষ্টি – ‘আজ বাজার মে…’। তরুণ কর্ণাটকি ক্ল্যাসিক্যাল ও গজল গায়ক হরিহরণের কন্ঠে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন ফয়েজ অনুরাগী দর্শকেরা।
সম্প্রতি ৬০ বছরে পদার্পণ করেছে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ রচিত এই কারাগৃহের গান। এত বছর পরে আজও এই গান, এই রচনা দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে দুই দেশে সমান আদৃত। আজও ফয়েজের পাশাপাশি সমান শ্রদ্ধার আসনে বিরাজমান পাকিস্তানি গায়িকা নায়রা নূর। আজও নিঃশব্দে একের পর এক ইতিহাসের পাতায় শাসন ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে উজ্জ্বল প্রতিবাদের কন্ঠস্বর রূপে উঠে এসেছে অসম্ভব সুন্দর ও মর্মস্পর্শী এই রচনাটি। সুরের সেই অবিনাশী আলোয় আজও সমুজ্জ্বল ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও নায়রা নূরের মত ক্ষণজন্মা প্রতিভারা। এই আলো সদা অক্ষুন্ন থাকবে দুই দেশের সঙ্গীতপ্রেমী মানুষদের মধ্যে দিয়েই।
ইংরাজি অনুবাদঃ
aaj
bazaar main pa bajolan chalo
let
us walk in bazaar in shackles
Chashm-e-nam,
jaan-e-shoreeda kafi nahin
wet eyes and restless soul is not enough
Tohmat-e-ishq-posheeda
kafi nahin
being charged for nurturing concealed love is not enough
aaj
bazaar main pa-bajolan chalo
let us walk in bazaar in shackles
Dast
afshan chalo, mast-o-raqsan chalo
let us go with afshan in hand, in trance and dancing
Khak
bar sar chalo, khoon badaman chalo
go with dust on head and blood on garb
Rah
takta hai sub shehr-e-janaan chalo
Go as the city of my beloved is waiting
Hakim-e-shehr
bhi, majma-e-aam bhi
City’s ruler and crowd of commoners
Teer-e-ilzam
bhi, sang-e-dushnam bhi
arrow of false charge, stone of accusation
Subh-e-nashaad
bhi, roz-e-naakaam bhi
morning of sorrow, day of failure
Unka
dum-saaz apnay siwa kaun hai
who is their friend except me
Shehr-e-janaan
main ab baa-sifa kaun hai
who is untainted in the city of beloved
Dast-e-qatil
kay shayan raha kaun hai
who deserve the killers or executioners hand
Rakht-e-dil
bandh lo, dil figaro chalo
get ready for the journey of heart, go wounded heart
Phir hameen qatl ho aain yaro chalo
let me go to be executed
রচনাঃ ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ
অনুবাদঃ আনিস জুবেরী
ছবি সৌজন্যে ডিডব্লু ডট কম।