বিমল মান্না
সুন্দরবনে মেধার অভাব নেই। প্রতি বছর মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের মেধা তালিকায় সুন্দরবনের অনেক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নাম দেখা যায়। কিন্তু সমস্যাটা হল, স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পরেই সুন্দরবনের ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে পড়তে থাকে।
উচ্চ শিক্ষার জন্য তাদের নিজেদেদের গ্রাম ছেড়ে মহকুমা সদর বা জেলা সদরে ছুটতে হয়। সুন্দরবনে যথেষ্ট সংখ্যক কলেজ গড়ে ওঠেনি। তাই প্রতি বছর স্কুল পাশ করা কয়েকশ পড়ুয়াকে ছুটতে হয় কলকাতায়। এখানে বলে রাখা দরকার, সমস্ত পরিবারের সামর্থ্য নেই সন্তানকে বড় শহরে রেখে পড়ানোর। মূল বাধা খরচ। কৃষি প্রধান সুন্দরবনে কৃষিকাজ আর লাভজনক নয়। নিজেদের পেটের ভাত জোগাড় করতেই কৃষকদের হিমসিম খেতে হয়। তাদের হাতে অর্থ বড্ড কম। তাই অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের পর আর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে না। ছাত্রীদের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। সরকারের তরফ থেকে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে নানা অভিযান, প্রচার চললেও সুন্দরবনের বিভিন্ন গ্রামে এখনও অনেক স্কুল পড়ুয়া বালিকার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে স্কুল পাশ করার পর অধিকাংশ ছাত্রের গন্তব্য হয় কেরলের মতো দক্ষিণ ভারতের কোনো রাজ্য। সেখানে তারা শ্রমিকের কাজ করতে যায়। সুন্দরবনে স্কুলছুট পড়ুয়ার সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। আর যারা মোটামুটি স্কুল পাশ করছে বা কলেজে পড়াশুনা করছে, তাদের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ একটা বড় সমস্যা। গ্রামে কাজের সুযোগ কিছু নেই বললেই চলে। তাই পড়াশুনা করার পর তাদের কাজের খোঁজে শহরে ছুটতে হয়।
কাকদ্বীপ মহকুমার পাথরপ্রতিমা ব্লকের একটি উল্লেখযোগ্য স্কুল হল দক্ষিণ লক্ষ্মী নারায়ণপুর যুধিষ্ঠীর বিদ্যাপীঠ। প্রথমে স্কুলটি জুনিয়র হাইস্কুল ছিল। পরে মাধ্যমিক স্তরে উত্তীর্ণ করা হয়। আমার পড়শুনা এই স্কুলেই। ২০০৫ সালে এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করি। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় আসতে হয়। যুধিষ্ঠীর বিদ্যাপীঠে পড়াশুনা করার সময় স্কুলছুট সমস্যা সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। পঞ্চম শ্রেণীতে যাদের সঙ্গে ভরতি হয়েছিলাম, মাধ্যমিক দেওয়ার সময় তাদের অনেককেই দেখতে পাইনি। বিশেষত অনেক ছাত্রীকে তাদের পরিবার ষষ্ঠ শ্রেণীতে পাঠরতা অবস্থাতেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে – এরকম নজির রয়েছে। তাছাড়া ভালো শিক্ষকেরও অভাব রয়েছে সুন্দরবনের স্কুলগুলিতে। যুধিষ্ঠীর বিদ্যাপীঠে কলকাতা বা দূরবর্তী জেলা থেকে আগত এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষকরা বেশিদিন এই স্কুলে থাকতেন না। কিছুদিন থাকার পরই তারা ট্রান্সফার নিয়ে শহরের স্কুলে চলে যেতেন। এর পিছনে অনেক কারণ আছে। প্রথমত যোগাযোগ ব্যবস্থা। সুন্দরবনে এখনও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। যেমন ধরা যাক যুধিষ্ঠীর বিদ্যাপীঠের কথা। ইদানিং প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার পাকা রাস্তা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সময় এই স্কুলে যেতে হলে মাটির রাস্তা দিয়েই যেতে হত। হরিমন্দির বাজারের পর থেকে স্কুল পর্যন্ত ছিল মাটির রাস্তা। বর্ষাকালে এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা ছিল যথেষ্ট কষ্টসাধ্য কাজ। রাস্তা রীতিমতো ডোবায় পরিণত হত। চারিদিকে কাদা। জল ভরতি গর্ত। বর্ষাকালের কয়েকটা মাস এই রাস্তা দিয়েই স্কুলে যাতাযাত করতে হত শিক্ষক থেকে পড়ুয়া – সবাইকে।
এই লেখা লেখকের ব্যক্তিগত মতামত। এর জন্য দৈনিক সুন্দরবন কোনোভাবেই দায়ী নয়।