ডি কে মুখোপাধ্যায়
কলেজ স্ট্রিটের একটি নামজাদা, পুরানো প্রকাশনা সংস্থার বিজ্ঞাপনটা দেখেছেন ? মূলত স্কুলের রেফারেন্স বই প্রকাশকারী এই সংস্থার বিজ্ঞাপনটি বাংলা সংবাদ চ্যানেলগুলিতে বিরতির সময় এখন দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, মা সোফার এক পাশে বসে রয়েছেন, অন্যদিকে পড়াশুনা করছে তার স্কুলপড়ুয়া শিশু। ঘরে রয়েছেন ওই শিশুর মায়ের এক বান্ধবী। শিশুটিকে দুলে দুলে পড়তে দেখে বান্ধবীর প্রশ্ন, বাহ! তোর ছেলে তো বেশ মন দিয়ে পড়ছে!
বান্ধবীর এই মন্তব্যে গর্বিত সুরে মা জানান, এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে ওই প্রকাশনা সংস্থার বই। তারপরই শেষ হয় কয়েক সেকেন্ডের এই বিজ্ঞাপন। তার আগে রয়েছে একটি ক্যাচলাইন। “স্মার্ট মাম্মির স্মার্ট বাচ্চা”।
বাংলায় মা কবে মাম্মি হয়ে গেল, মা আর মামি কবে থেকে এক হয়ে গেল, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা ভীষণ জরুরি। রোদ্দুর রায়ের খিস্তি এবং খিল্লি নিয়ে আলোচনা পরে হবে। একটা জাত দিনের পর দিন তার ভাষাকে নিজে মুখেই মেরে ফেলছে। বিকৃত উচ্চারণ করছে। অর্পিতা কবেই আর্পিতা হয়ে গেছে, আর সঞ্চিতা হয়ে গিয়েছে স্যাঞ্চিতা তা আপনি হয়তো খেয়াল করেননি।
আপনি যদি ইউটিউব ঘাঁটেন টাঁটেন, তাহলে দেখতে পাবেন এই মুহূর্তে বাংলায় যে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ভ্লগার (ভিডিও ব্লগ) তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রোদ্দুর রায়। তিনি নিজেকে বিশ্বকবি বলে দাবি করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানা গান তিনি নিজের মতো করে গান। সেই গানের সুরও যেমন মূল গানের সুরের থেকে পৃথক, তেমনি সেই গানের কথায়ও রোদ্দুর নিজের কিছু শব্দ যোগ করেছেন। সেগুলি মূলত বিভিন্ন খিস্তি। রবীন্দ্রভক্তদের অভিযোগ, রোদ্দুরের এই বাঁদরামো মেনে নেওয়া যায় না। অনলাইনে বিভিন্ন ফোরামে রোদ্দুর রায়কে নিয়ে ট্রল করা হয়। তাকে পাগল বলেন অনেকে।
তবে বাস্তব হল, রোদ্দুর রায় পাগল নন। যে বাঙালি মা কে মাম্মি বলতে পারে, অর্পিতাকে আর্পিতা উচ্চারণ করতে পারে, যৌন শিক্ষায় নাক সিঁটকিয়ে বাথরুমে ঢুকে সানি লিওনের ছবি দেখতে পারে, সে অন্তত রোদ্দুরকে পাগল বলতে পারে না। ট্রল আপনি করতেই পারেন, রোদ্দুরের গান এবং খিস্তিতে আপনার গায়ে জ্বালা ধরতেই পারে। তবে তার আগে আপনাকে রোদ্দুরকে বুঝতে হবে। তার ভাবনাকে বুঝতে হবে।
কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর দেদার বাংলা ব্যান্ড এবং বাংলা ছবিতে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হচ্ছে। তবলা, হারমোনিয়ামের বদলে গিটার এবং ড্রামসের শব্দে এখন রবীন্দ্রসংগীত শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। নচিকেতা যখন গাইলেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে নাকি একলা চলতে হয়। সেসব ক্ষেত্রে তো বাঙালিকে এতটা উচাটন হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। তাহলে রোদ্দুরের চাঁদ উঠেছিল গগনে নিয়ে এত আপত্তি কেন! আপত্তির কারণ যদি খিস্তি হয়, তাহলে সেটা আপনার ব্যক্তিগত সমস্যা। ব্যাপারটাকে জেনারালাইজ করবেন না। রোদ্দুর তার চ্যানেলে স্পষ্ট লিখেছেন, তিনি পোস্ট মর্ডান পোয়েট। শুধু গান নয়, তিনি কবিতাও লেখেন। এই সব কিছুকে যদি খিস্তির মাপকাঠি দিয়ে বিচার করেন, তাহলে উত্তর আধুনিকতাবাদ কি, সে সম্পর্কে আপনার স্পষ্ট ধারনা তৈরি হবে না।
যা কিছু প্রচলিত, যা কিছু সর্বজন গ্রাহ্য, তা ধ্রুব সত্য হতে পারে না। খুব সহজ ভাষায় বললে, এটাই হল পোস্ট মর্ডানিজমের নির্যাস। ঠিক এটাই ফুটে ওঠে রোদ্দুরের গান, কবিতা এবং বিচিত্র নৃত্য ভঙ্গির মাধ্যমে। ইউটিউবে তার লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার, হাজার হাজার ভিউস এটাই প্রমাণ করে, যতই তাকে নিয়ে ট্রল করা হোক, রোদ্দুর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যারা চাঁদ উঠেছিল গগনে শুনে গেল গেল রব তুলেছেন, তারাই দিন রাত চার অক্ষরের খিস্তি ব্যবহার করেন, রোদ্দুরের ওই ভিডিও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেন এবং মজা উপভোগ করেন।