অভিযোগটা নতুন নয়। তবে চিনা সরকার কোনোদিনও সেটা স্বীকার করেনি। তবে আল জাজিরার নতুন ভিডিও ফুটেজ থেকে আরও স্পষ্ট, গত বছর উহানে কোভিড মহামারি দেখা দেওয়ার পর চিন সরকার এই খবর চেপে দেওয়ার প্রবল চেষ্টা করেছিল। বা যেটুকু তথ্য সামনে এসেছে, সেটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে কোভিড থাবা বসিয়েছিল চিনের উহান শহরে। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে একটা বছর। এখনও বিশ্বের বিভিন্ন অংশ কোভিড তার তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে। তবে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে। বিশেষত কোভিডের টিকা মার্কেটে চলে আসায় মানুষ আগের মতো আর অতটাও আতঙ্কিত নন। সম্প্রতি উহানের কোভিড রহস্য নিয়ে একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল জাজিরা। সেই প্রতিবেদন থেকে গত বছর কোভিডের সময় উহানের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী দেখা গিয়েছে। দুই সাংবাদিক কোভিড পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গেলেও কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত প্রশাসনের আধিকারিকরা তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে দেয়নি। বারবার বাধার মুখে পড়তে হয়েছে ওই সাংবাদিকদের। তবুও গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন ওই সাংবাদিকরা। সুরক্ষার স্বার্থে ওই সাংবাদিকদের প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। ভিডিওগুলি যেহেতু সরকার বিরোধী, তাই চিনে কোনো সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশ করা যায়নি। সেই ভিডিওগুলি আল জাজিরা হাতে পেয়ে প্রকাশ করেছে।
3 Days that Stopped the World নামে আল জাজিরার ওই তথ্যচিত্রে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ যখন উহানে প্রথমবার কোভিডের উৎস পাওয়া যায়, তখন স্থানীয় মানুষ বিষয়টি নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিলেন না। মাস্ক, স্যানিটাইজার বা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স মেনে চলা দূরের কথা, তারা এই রোগকে আর পাঁচটা সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশির মতো ভেবেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলায়। বাধ্য হয়ে রাত ২ টোর সময় উহানে লকডাউন ঘোষণা করা হয়।
ইয়াং জুন এবং চেন ওয়েই নামে দুই সাংবাদিক (আসল নাম নয়) গত বছরের জানুয়ারির গোড়ার দিকে কোভিড নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে বেজিং থেকে উহানে গিয়েছিলেন। তখন এই নোভেল ভাইরাসে চিনে কয়েকশ মানুষ আক্রান্ত। যদিও চিনা সরকার এই ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানায়নি। ওই দুই সাংবাদিক উহানের কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, করোনার উপসর্গ নিয়ে শয়ে শয়ে মানুষ প্রতিদিন হাসপাতালে আসছেন। পরিস্থিতি এরকম পর্যায়ে পৌঁছায় যে কিছু হাসপাতালে করিডোর এবং মেঝেতে রোগীদের ঠাঁই হয়। স্থানীয় হুনান সি ফুড মার্কেটে সাংবাদিকরা গিয়ে বিশদ তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এক সাংবাদিকের ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়। তাকে বেআইনীভাবে গাড়িতে বসিয়ে রেখে হেনস্থা করা হয়। সাংবাদিক পরিচয় দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। এমনকি ছবি তোলার প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র তার কাছে থাকলেও পুলিশ সেকথা শুনতে রাজি ছিল না।
গুরুত্বপূর্ণ প্রথম কয়েকদিন
প্রথমদিকে ওই সাংবাদিকরা ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি উহানে পৌঁছেছিলেন। তখনও কোভিড-১৯ এর তীব্রতা সম্পর্কে সবার স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়নি। হিউম্যান-টু-হিউম্যান ট্রান্সমিশন নিয়ে তখনও পাওয়া যায়নি কোনো নিশ্চিত তথ্য। তাই স্থানীয় মানুষ এই ভাইরাস নিয়ে বিশেষ চিন্তিত ছিলেন না। কাউকে তখন মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। এই ভাইরাসকে সবাই একটা সাধারণ ফ্লু হিসাবে বিবেচনা করেছিল। ২০০২ এবং ২০০৪ সালে সেখানে হানা দেওয়া সার্স মহামারির চেয়ে যে এই নয়া ভাইরাস ভয়ঙ্কর হতে পারে, সে সম্পর্কে তারা কিছু আন্দাজ করতে পারেননি। সার্স ফ্লুতে সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সাংবাদিক জুন তার ডায়ারিতে লিখেছেন, আমি যখন উহানে পৌঁছাই, তখন দেখলাম কোভিড নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে কোনো উদ্বেগ নেই। তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। এমনকি অনেকে এই ভাইরাস সম্পর্কে তখনও শোনেননি। আমাকে মাস্ক পরে থাকতে দেখে এক দোকানদার বলেন আমি যেন সেটা খুলে ফেলি। তার বক্তব্য, আমি একটু বেশি ভয় পাচ্ছি! সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
স্থানীয় প্রশাসন কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছিল যে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে। তাই হুনাব মার্কেট সিল করে দেওয়া হয়। তবুও হুনান বা বেজিংয়ে থাকা চিনা প্রশাসনের কর্তারা কোভিড-১৯ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারেননি। নিজের দেশের নাগরিকদেরকেও তারা পর্যাপ্ত তথ্য জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। যদিও সেই সময় চিনের তরফ থেকে এই নয়া করোনাভাইরাস সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অবগত করা হয়েছিল। তবে হু তখনও বুঝতে পারেনি যে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
জানুয়ারি মাস হওয়ায় নতুন বছরের বিভিন্ন উৎসবে মেতে ওঠেন উহানের বাসিন্দারা। আর পাঁচটা বছরের মতো তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যান। আর সম্ভবত এই কারণেই তড়িৎ গতিতে ছড়িয়েছে সংক্রমণ।
সরকারি সেন্সরশিপ
যে কাজ সরকারের করা উচিত ছিল, কোভিড-১৯ নিয়ে মানুষকে সতর্ক, সচেতন করা, সেই কাজ সংবাদমাধ্যমের কিছু প্রতিনিধি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চিনা সরকারের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। এমনকি খাতায়-কলমে উহানে করোনা আক্রান্তের যে সংখ্যা দেখানো হয়েছিল, সেটা বাস্তবের চেয়ে অনেক কম বলেই জানিয়েছেন সাংবাদিকরা। সরকারের তরফ থেকে সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। ফলে কোভিডের তথ্য নিয়ে মানুষের মধ্যে শুরুর দিকে ধোঁয়াশা ছিল। প্রথম দিন থেকেই মানুষ মাস্ক পরা, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়ার মতো চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করেনি। কোভিডের তথ্য নিয়ে চিনা প্রশাসন একটা গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করছিল। কোভিড-১৯ যে চিনে মহামারি তৈরি করেছে বা করতে পারে, এমন শব্দ সেদেশের সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করতে পারে না। কারণ তাতে সরকারের গোঁসা হবে। কোপ পড়বে সংবাদমাধ্যমে। আর এর মাধ্যমেই প্রকৃত তথ্য লাভ করা থেকে বঞ্চিত হন সাধারণ মানুষ।
কোভিড পরিস্থিতি যাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশ জানতে না পারে, তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল চিনা সরকার। বিশেষত কোনো সাংবাদিক যদি এই বিষয়ে রিপোর্টিং করতেন, তাকে বাধা দেওয়া হত, তার উপর অনবরত নজর রাখা হত। গত বছর চিনে করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকে অন্তত নয় জন চিনা সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে বা তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। করোনা সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের অপরাধে গত ডিসেম্বর মাসে বিখ্যাত সিটিজেন জার্নালিস্ট ঝ্যাং ঝানকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ, ওই রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে তিনি অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। তবে সেটা মোটেও সত্য নয়।
বিশ্বব্যাপী মহামারি
করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বে মহামারি তৈরি করলেও গত কয়েক মাসে পরিস্থিতি বেশ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিশেষত করোনার ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে এর মধ্যেই টিকাকরণ কর্মসূচী শুরু হয়েছে। তবে সমগ্র বিশ্ব করোনামুক্ত হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। উহানের অবস্থা এখন কেমন? ওয়েই নামে ওই সাংবাদিক তার ডায়ারিতে লিখেছেন, উহান ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়েছে। এখন কেউ আর ভাইরাস নিয়ে কথা বলেন না। এটা ইতিহাসের সেই অধ্যায়, যা পেরিয়ে গিয়েছে। চিনের জনগণ এখনও মনে করেন, চিনা সরকার সময় মতো কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হত। যদিও সাউদ্যাম্পটন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা বলছে, চিনা সরকার যদি উহানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও দ্রুত পদক্ষেপ নিত, তাহলে করোনা নিয়ে সমগ্র বিশ্বের বর্তমানের মতো পরিস্থিতি তৈরি হত না।