সুপর্ণা দাস
(১)
বনবিবির ভক্ত দুখের সঙ্গেআগেই আলাপ হয়েছে আমাদের। কেঁদোখালির চরেঅসহায় দুখেকে মেরে নরমাংসের খিদে মেটাতে চেয়েছিলেন বাঘরূপী,রাক্ষসরাজ দক্ষিণ রায়। শেষমেশ, অরণ্যের দেবী বনবিবি আর তাঁর ভাই শাহ জঙ্গলির কাছে যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যান তিনি। আরাধ্যার শরণাপন্ন হয়ে প্রাণ বাঁচে রাখাল যুবকের।সুন্দরবনের আনাচকানাচে আজও বনবিবিই ভরসা বাঘ-কুমিরের সঙ্গে ঘর করা মানুষগুলোর। পেট চালাতে জল-জঙ্গলে এঁদের রোজের ‘অভিযান’! কেউ খাঁড়ির জলে মাছ, কাঁকড়া, মিন ধরেন। কেউ বা গভীর বনে যান মধু আর মোমের সন্ধানে। ঠিক যেমন গিয়েছিল ধনা মৌলি আর দুখে। এখানকার মানুষের বিশ্বাস, আজও গড়ান, গেঁওয়া, সুন্দরীর আড়ালে ওঁৎ পেতে থাকেন দক্ষিণ রায়। নররক্তের তেষ্টা, নরমাংসের খিদে আজও মেটেনি তাঁর। তাই আসেন হলদে-কালো ডোরার ছদ্মবেশে। সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন কোনও মৌলি, জেলে বা কাঠুরের ঘাড়ে। টুঁটি ধরে নিয়ে যান নিজের ডেরায়। তারপর সেখানেই সারেন ভোজ। তাই আজও কাজে বেরোনোর আগে বনবিবির পুজো করেন সুন্দরবনের মৌলি, জেলে কাঠুরেরা। তাঁদের বিশ্বাস, দক্ষিণ রায়ের মুখোমুখি হলেঅরণ্যের দেবীই রক্ষা করবেন তাঁদের। ঠিকে যেমন তিনি রক্ষা করেছিলেন তাঁর পরম ভক্ত দুখেকে।
(২)
কে এই বনবিবি? সুন্দরবনের মতো জল-জঙ্গলের রাজ্যে তাঁর আগমন হল কীকরে? এ নিয়ে মিথের অভাব নেই। যার সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে মানুষের বিশ্বাস আর লোকগাথা। দেবীর মাহাত্ম্য় নিয়ে বেশ কিছু পুঁথিও আছে। যার মধ্যে অন্যতম ‘বনবিবির কেরামতি’ এবং ‘বনবিবির জহুরানামা’। ছন্দে কথায় বনবিবির মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য প্রখ্যাত কবিদের মধ্যে রয়েছেন বায়ানুদ্দিন, মহম্মদ খাতের প্রমুখ। বিখ্যাত লেখক অমিতাভ ঘোষ ২০০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর পরিবেশ সংক্রান্ত উপন্যাস ‘দ্য হাংরি টাইড’-এও বনবিবির প্রসঙ্গ টেনেছেন।বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে, কবিতায়, প্রচলিত লোকগাথায় কখনও এই দেবীর নাম বনবিবি, কখনও বা তিনি বনদুর্গা। কোথাও কোথাও তাঁকে ব্যাঘ্রদেবীও বলা হয়। সবথেকে বড় বিষয় হল, আজকের দিনে যখন স্রেফ রাজনীতির স্বার্থে দেশজুড়ে ধর্ম নিয়ে অনর্থক হিংসা, বিবাদ আর হানাহানি বাড়ছে, ঠিক তখনই সুন্দরবনের এই আরাধ্যা দেবী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির। হিন্দু ও মুসলিম, দুই ধর্মের মানুষই মিলেমিশে তাঁর পুজো করেন। যা ধর্মের জিগির তোলা দাঙ্গাবাজদের গালে সপাটে চড়।
(৩)
প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস বা লোকগাথা বাদ দিলে আধুনিক যুগের লেখক ও সাহিত্যিকদের কলমেও বারবার উঠে এসেছে বনবিবির কথা। ১৯৫৯ সালে প্রথমবার প্রকাশিত হয় ‘আগ কা দরিয়া’। রচয়িতা কুরাতুলাইন হায়দার। উপন্যাসের একটি ফুটনোটে তিনি লিখেছিলেন, বনবিবি আদতে পয়গম্বর মহম্মদের মেয়ে ফতিমা। বনবিবিকে নিয়ে প্রচলিত জনশ্রুতির সঙ্গে এর মিলও রয়েছে। সুন্দরবনের মানুষের বিশ্বাস, বনবিবির বাবা বেরাহিম বা ইব্রাহিম। তিনি ছিলেন মক্কার একজন ফকির। তাঁর প্রথম স্ত্রী ফুলবিবির কোনও সন্তান ছিল না। তাঁর অনুমতি নিয়েই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন ইব্রাহিম। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম গোলাবিবি। স্বামীকে দ্বিতীয়বার বিয়ের অনুমতি দিলেও, তারজন্য একটি শর্ত আরোপ করেছিলেন ফুলবিবি। তাঁর শর্ত ছিল, ভবিষ্যতে ইব্রাহিমকে তাঁর প্রথম স্ত্রীর যে কোনও একটি অনুরোধ বিনা বাক্যব্যয়ে মানতে হবে। এদিকে, জন্নত বা স্বর্গে তখন অন্য কোনও জটিল ব্যাপার-স্যাপার চলছিল। এক স্বর্গীয় কাজ সম্পন্ন করার জন্য আল্লাহ (ঈশ্বর) স্থির করলেন বনবিবি এবং শাহ জঙ্গলিকে জন্নত থেকে মর্ত্যে পাঠাবেন। আল্লাহ দু‘জনকে নির্দেশ দিলেন, তাঁরা যেন ইব্রাহিমের দ্বিতীয় স্ত্রী গোলাবিবির গর্ভজাত সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন। এই পরিস্থিতিতে গোলাবিবি গর্ভবতী হতেই ইব্রাহিমকে তাঁর দেওয়া পূর্বশর্ত পালনের অনুরোধ করলেন তাঁর প্রথম স্ত্রী ফুলবিবি। শর্ত এবং সত্য়রক্ষার তাগিদে অন্তঃসত্ত্বা গোলাবিবিকে জঙ্গলে ফেলে গেলেন ইব্রাহিম। সেখানেই ফুটফুটে একটা মেয়ে আর একটা ছেলের জন্ম দিলেন গোলাবিবি। সদ্যোজাতদের দেখভালের জন্য স্বর্গ থেকে চার পরিচারিকাকে মর্ত্যে পাঠালেন আল্লাহ। কিন্তু জন্মদাত্রী তাঁর মেয়ের সঙ্গে সুবিচার করলেন না। সদ্যোজাত পুত্র সন্তানকে কোলে নিয়েই চলে গেলেন তিনি। একরত্তি মেয়েটাকে ফেলে গেলেন গভীর অরণ্যে। এক হরিণ মায়ের কাছে বেড়ে উঠল সেই শিশু। তাই ফকিরের ঘরে জন্ম নিয়েও তিনি বনবাসী, অরণ্যের সন্তান।কালক্রমে তিনিই হলেন অরণ্যের দেবী, অরণ্যবাসীর আরাধ্যা বনবিবি। তাঁর জন্মের সাত বছর পর অবশ্য ইব্রাহিম নিজের ভুল বুঝতে পারেন। ফকির বোঝেন, প্রথম স্ত্রীর শর্তরক্ষার নামে দ্বিতীয় স্ত্রী ও তাঁর দুই সন্তানের সঙ্গে অন্যায় করেছেন তিনি। তাই ভুল শোধরাতে গোলাবিবি আর তাঁর দুই সন্তানকে মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যান ইব্রাহিম।
(৪)
মক্কায় ফিরে নাগরিক জীবনে অভ্যস্থ হয়ে ওঠেন বনবিবি আর তাঁর ভাই শাহ জঙ্গলি। একদিন মসজিদে প্রার্থনা করার সময় দু‘টো জাদুটুপি পান তাঁরা। সেই টুপিই তাঁদের উড়িয়ে আনে হিন্দুস্তানের (ভারতের) আঠারো ভাটির দেশে (সুন্দরবন)। সেদেশের শাসক তখন রাক্ষসরাজ দক্ষিণ রায়। তাঁর তালুকে এসেই আজানে বসেন শাহ জাঙ্গলি। সেই প্রার্থনার সুর দক্ষিণ রায়ের কানেও যায়। কে এভাবে ঈশ্বরের আরাধনায় বসেছে তা জানতে বন্ধু সনাতন রায়কে তদন্তে পাঠান দক্ষিণ রায়। সবদিক দেখে-শুনের ভাইবোনের আগমনের কথা রাজাকে জানান সনাতন। দক্ষিণ রায় স্থির করেন, তখনই সেই ভিনদেশীদের বিদেয় করবেন। বেঁকে বসেন দক্ষিণ রায়ের মা নারায়ণী। ছেলেকে যুদ্ধে যেতে বাধা দেন তিনি। বদলে নারায়ণী নিজেই ভূত আর অপদেবতাদের নিয়ে বনবিবির সঙ্গে লড়তে যান। সে লড়াই চলেছিল বহুদিন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য যুদ্ধে হেরে যান নারায়ণী। কিন্তু বনবিবির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বন্ধুর সঙ্গে সন্ধি করেন অরণ্যকন্যা। ঠিক হয়, আঠারো ভাটির দেশ দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবেন বনবিবি। বসত এলাকায় রাজ্য চালাবেন তিনি নিজে। আর গভীর জঙ্গলের অধিকার থাকবে দক্ষিণ রায়ের হাতে। তাই আজও দক্ষিণ রায়ের তালুকে ঢোকার আগেবনবিবির পুজো করেন তাঁর রাজ্যের প্রজারা।
এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবিটি তুলেছেন পরিতোষ গিরি।