পাঁচুগোপাল মান্না
চিংড়ি চাষ, ফিশারি তৈরির জন্য সুন্দরবনে যথেচ্ছভাবে কাটা হচ্ছে ম্যানগ্রোভ। বাইরের কেউ নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ এই কাজে যুক্ত। এমনই চাঞ্চল্যকর দাবি করলেন পরিবেশবিদরা। তারা জানিয়েছেন, নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে কোপ পড়ায় সুন্দরবনে সংকট আরও বাড়বে।
সুন্দরবনের জঙ্গলে বেআইনীভাবে গাছ কাটার রেওয়াজ বহুদিন ধরেই চলছে। উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অংশে এই প্রবণতা দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, দিনকে দিন চিংড়ি, মাছ চাষের জন্য সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে আরও বেশি কোপ পড়ছে।
১০,০০০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি অংশজুড়ে অবস্থিত সুন্দরবন বাংলাদেশ এবং ভারতে অবস্থিত। সুন্দরবন হল বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এটিই হল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র বাসস্থান। বাংলাদেশে প্রায় ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার অংশজুড়ে সুন্দবন অবস্থিত। আমাদের প্রতিবেশি দেশেই সুন্দরবনের জঙ্গলের প্রায় ৬০ শতাংশ রয়েছে। অবশিষ্ট অংশ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত।
সম্প্রতি একটি ঘটনার মাধ্যমে জানা গিয়েছে কিভাবে বাসন্তী ব্লকের ভরতগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের আনন্দবাদ এলাকায় ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে ম্যানগ্রোভ। সপ্তাহ খানেক পরে কর্তৃপক্ষের নজরে বিষয়টি আসার আগেই এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে এই বৃক্ষ নিধন চলেছে।
জি নিউজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পুলিশ আধিকারিকরা ঘটনাস্থালে সারপ্রাইজ ভিজিটের জন্য গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তারা দেখতে পান, রীতিমতো জেসিবি মেশিন দিয়ে ম্যানগ্রোভ গাছ কাটা হচ্ছে। যারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের অধিকাংশই পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ধরা পড়ে যান জেসিবির ড্রাইভার।
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। এলাকায় বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সুন্দরবনের মহেশপুর এবং আনন্দবাদে ম্যানগ্রোভের চারা রোপণ করা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন দপ্তরের উদ্যোগে। তবে সম্প্রতি এই এলাকাগুলিতে দেখা যায়, ব্যাপকভাবে ম্যানগ্রোভ সাফ করে দিয়েছেন কিছু মানুষ। পবিবেষবিদ সুভাষ দত্তের মতে, সুন্দরবনের স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ চিংড়ি ও মাছ চাষের জন্যই ম্যানগ্রোভে কোপ মারেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, স্থানীয় বাসিন্দাদের এই প্রবণতা রুখতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সুভাষবাবু বলেন, এই এলাকাগুলিতে ম্যানগ্রোভ অরণ্য নিধন বন্ধ করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিছুই করেনি। এমনকি ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল এই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আমরা আরও জানতে পেরেছি যে রাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ এই ধরণের প্রথায় উৎসাহ প্রদান করছেন।
তিনি আরও যোগ করেন, এই সমস্যা সুন্দরবনের জন্য বিশাল সংকট তৈরি করেছে। যদি বিষয়টার প্রতি নজর দেওয়া না হয়, তাহলে সুন্দরবনের ভূগোল শীঘ্রই ইতিহাসে পরিণত হবে। এটা বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে না। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য রক্ষা করতে সরকারী এজেন্সি, এনজিটি এবং স্থানীয় নেতৃত্বকে একজোট হতে হবে।
এই প্রসঙ্গে রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব ব্যানার্জীকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে বন দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, সুন্দরবনের বাসন্তী ব্লকে অবৈধ কাজকর্ম সম্পর্কে আমরা অবগত এবং এই মর্মে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আধিকারিক বলেন, বছরের পর বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছে। রাজ্য সরকার বেশ কিছু মানুষকে গ্রেফতার করেছে। তবে সম্প্রতি আমাদের জানানো হয়, ফের ম্যানগ্রোভ অরণ্য কাটা শুরু হয়েছে। যারা আইন অমান্য করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা নিশ্চিত করব যাতে ওই এলাকায় আর একটাও গাছ না কাটা পড়ে।
সম্প্রতি ভারতের পূর্বাংশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এবং ওডিশা ও প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে সাইক্লোন বুলবুল আছড়ে পড়ে। গত বছরের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক প্রাণহানি ও সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে। তবে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য না থাকলে এই সাইক্লোনের আছড়ে পড়ার ফল আরও ভয়ঙ্কর হত। সুভাষবাবু বলেন, এইভাবে ম্যানগ্রোভের সংখ্যা দিনের পর দিন কমতে থাকলে ভবিষ্যতে সাইক্লোন হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
ছবি সৌজন্যে জি নিউজ।