প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। তবে নতুন কিছু একটা করার ইচ্ছে ছিল। আর ছিল নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার জেদ। এই হার না মানা মানসিকতার জন্যই আজ উত্তরবঙ্গ তথা শিলিগুড়ির একজন পরিচিত চিত্রশিল্পী হয়ে উঠেছেন দীপায়ন ঘোষ।
শিলিগুড়ির বাঘাযতীন পার্ক লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা দীপায়ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। শিলিগুড়ি বয়েজ হাইস্কুলে পড়াশুনা করেছেন। ছোটো বেলায় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে প্রথম ছবি আঁকার সঙ্গে পরিচিত হন। ধীরে ধীরে এই শিল্পের প্রতি তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। আর্ট কলেজের কোনো ডিগ্রি না থাকলেও স্রেফ প্রতিভা এবং কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি শিল্পী হিসেবে নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছেন।
শুধু শিলিগুড়ি কিংবা উত্তরবঙ্গ নয়, দেশ-বিদেশেও দীপায়ন বাবুর কাজ প্রশংসা অর্জন করেছে। ২০১১ সালে তার কলকাতার ‘ক্লোদস অ্যান্ড আদার’ শীর্ষক একক প্রদর্শনীত গ্যালারি চিত্রকূট এর তরফ থেকে আয়োজিত হয় । ২০১৮ সালে গ্যাংটকে বিগ আই আর্ট ফাউন্ডেশন শিলিগুড়ির (বিআইএএফএস) এর আয়োজনে গ্রুপ আর্ট শোতে তার কাজ প্রদর্শিত হয়েছে। ২০১৩ সালে গোয়ার কলা অ্যাকাডেমিতে দীপায়নবাবুর কাজ প্রশংসা অর্জন করেছিল। ২০১২ সালে কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ২০১২ সালে নয়াদিল্লির ললিত কলা অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্রভবনে উত্তরবঙ্গের এই শিল্পীর কাজ প্রদর্শিত হয়। অংশগ্রহণ করেন যোধপুর রাজস্থানের জাতীয় স্তরের আর্ট ক্যাম্পে। দেশের বিভিন্ন জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা গুলিতে বহুবার অংশগ্রহণ করেছেন।
নিজের শিল্পী জীবনে একাধিক পুরষ্কার ও সম্মান পেয়েছেন দীপায়নবাবু। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ২০১০ সালে কলকাতার বোধি ট্রি মনাস্ট্রি অব আর্টের ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগীতায় সেরার শিরোপা। জার্মানিতে সেই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমকালীনপ্রতিযোগিতায় ও প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।লন্ডনের নেহরু সেন্টারে যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
শিল্প চর্চার পাশাপাশি উত্তরবঙ্গে শিল্পীদের জন্য তিনি প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত করেছেন। শিলিগুড়িতে প্রথম ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি আর্ট গ্যালারি ৩৬০° স্থাপন করেছিলেন এবং সেখানে প্রথমবার স্থানীয় মানুষ ইনস্টলেশন এবং ভিডিও আর্ট একসঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। ২০১৭ সালে তিনি বিগ আই আর্ট ফাউন্ডেশন, শিলিগুড়ি (বিআইএএফএস) নামে একটি সংগঠন গড়েন। দীপায়ন বাবুর হাত ধরে এই সংগঠনের পথ চলা শুরু হয়। তিনি বিআইএএফএসের সেক্রেটারি পদের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এই সংগঠনের উদ্যোগে ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অংশে ৮টি উল্লেখযোগ্য আর্ট ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ইভেন্ট ছিল। সংগঠনের তরফে উত্তরবঙ্গে প্রথমবার মহিলাদের আর্ট এগজিবিশনের আয়োজন করা হয়েছিল ২০১৯ সালে। শি-২০১৯ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে শিলিগুড়িতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়।
বিভিন্ন শিল্প প্রদর্শনীমূলক অনুষ্ঠান আয়োজনের পাশাপাশি এই সংগঠন সমসাময়িক শিল্প প্রসঙ্গে শিক্ষামূলক কার্যাবলী এবং সেমিনারের আয়োজন করে চলেছে। বিআইএএফএস এর পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক আয়োজিত হয়ে গেল শিলিগুড়ি রামকিঙ্কর প্রদর্শনী কক্ষের শিল্পীর ১০বছরের বাছাই কিছু শিল্পকলার এক অভিনব প্রদর্শনী।
ব্যক্তিগতভাবে শিল্পী হিসেবে অনেক সাফল্য অর্জন করলেও সামগ্রিকভাবে উত্তরবঙ্গের শিল্পীদের প্রচার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন দীপায়নবাবু। তিনি বলেন, শিল্প চর্চার দিকে থেকে উত্তরবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের শিল্পীরা প্রচারের আলো থেকে বঞ্চিত। এছাড়া আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গের মানুষের মধ্যেও শিল্প সচেতনা বোধ এখনও তৈরি হয়নি। ফলে এখানে শিল্পীদের কদর পাওয়া যায় না।
শিল্পী জীবনে দীপায়নবাবুর যেমন অনেক সুখের মুহূর্ত আছে, তেমনি রয়েছে আক্ষেপও। নিজের ছবি প্রথমবার বিক্রি হওয়া তার বাবা দেখে যেতে পারেননি। তার আগেই তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন। এই নিয়ে এখনও তার গলায় আক্ষেপের সুর শোনা যায়।
উত্তরবঙ্গে শিল্প চর্চার জন্য যে উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই, তা এক কথায় স্বীকার করে নিয়েছেন দীপায়নবাবু। তবে শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে তিনি কোনো বিভেদ চাইছেন না। বরং তিনি বলেন, শিল্পী হিসেবে সবার একটাই পরিচয় থাকা উচিত, আমরা বাংলার শিল্পী।