কৃষি এবং মৎসচাষ সুন্দরবনের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবিকার অন্যতম প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছে কাঁকড়া চাষ। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে তীব্র গরম, জলের সমস্যা এবং জলে অক্সিজেন পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকায় সুন্দরবনে চিংড়ি চাষ ব্যহত হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কাঁকড়া চাষকে হাতিয়ার করেছেন সুন্দরবনের মৎসজীবীরা। তাদের এই উৎসাহের পিছনে আরও একটি বড় কারণ হল বিশ্বের বাজারে কাঁকড়ার ক্রমবর্ধমান চাহিদা। চিংড়ি চাষে কিছু ঝুঁকি থাকলেও কাঁকড়ার ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঝুঁকি নেই। তাই যত দিন যাচ্ছে, সুন্দরবনে কাঁকড়া চাষের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে।
বাংলা ট্রিবিউনের একটি রিপোর্টে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো খুলনার জানিয়েছে, ২০১৯ সালের প্রথম ৫ মাস ২৬ লাখ ৬১ হজার ডলার মূল্যের কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। তার আগের অর্থবর্ষে মোট ২৬ লক্ষ ৪০ হাজার ডলার মূল্যের কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়েছিল। চিংড়ি চাষের তুলনায় বেশি লাভজনক হওয়ায় বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা ও কয়রা, বাগেরহাটের রামপাল, মোংলা, বাগেরহাট সদর ও শরণখোলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি কালীগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলায় কাঁকড়া চাষ অনেকটাই বেড়েছে। খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ২৮ হাজার ৫৪৬ হেক্টর জমিতে ৬ হাজার ৯৮৯ মেট্রিকটন কাঁকড়া উৎপাদন হয়েছে।
কোথায় যাচ্ছে সুন্দরবনের কাঁকড়া


বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুন্দরবনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের কাঁকড়ার অন্যতম বড় বাজার হল চিন। এছাড়া তাইওয়ান, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ায় রফতানি হয়েছে। এই সব দেশে হিমায়িত চিংড়ির চেয়ে সুন্দরবন অঞ্চলের কাঁকড়া বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কাঁকড়ায় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও বেশি হচ্ছে। কাঁকড়া চাষে রোগ আক্রমণের সম্ভাবনা কম। ফলে লোকসানের ঝুঁকিও কম। বিদেশের বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়। এর ফলে বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন ১৩টি উপজেলায় কাঁকড়ার চাষ বেড়েছে।
আয় কত
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো খুলনা সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৯ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ২৬ লাখ ৬১ হাজার ডলার মূল্যের কাঁকড়া রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই মাসে ৩ লাখ ৯৭ হাজার ডলার, আগস্ট মাসে ৫ লাখ ৬৩ হাজার ডলার, সেপ্টেম্বর মাসে ৯ লাখ ২৫ হাজার ডলার, অক্টোবর মাসে ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৪৯০ ডলার ও নভেম্বর মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬১ ডলার মূল্যের কাঁকড়া বিদেশে রফাতানি হয়েছে। গত অর্থ বছর খুলনা অঞ্চল থেকে কাকড়া রফতানির পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার। বিদায়ী অর্থ বছরের শেষ মাসে (জুন মাসে) এই অঞ্চল থেকে ২ লাখ ৬৯১ ডলারের কাঁকড়া রফতানি করা হয়েছিল। এছাড়া জুলাই ২০১৮ সালে ৯৭ হাজার ৭৫০ ডলার, সেপ্টেম্বরে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭২২ ডলার, অক্টোবর ২ লাখ ৭০ হাজার ৭৭২ দশমিক ৯৩ ডলার, নভেম্বর মাসে ১ লাখ ১২ হাজার ৬৫০ ডলার, ডিসেম্বরে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৬২৯ ডলার, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৯৫ দশমিক ৫০ ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮২৬ ডলার ও মে মাসে ৭১ হাজার ৯৫৫ ডলারের কাঁকড়া রফতানি করা হয়েছে।
কি বলছেন ব্যবসায়ীরা
কাঁকড়া রফতানিকারক শেখ ওয়াহিদুজ্জামান লাবু জানান, ‘মোংলা বন্দর সংলগ্ন দিগরাজ মোকাম থেকে রফতানির জন্য প্রতিদিন ১০ মেট্রিক টন কাঁকড়া ঢাকার নলভোগ আড়তে পাঠানো হয়। কাঁকড়া প্রকারভেদে কেজি প্রতি সাড়ে ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। চিন ও তাইওয়ানে সুন্দরবন অঞ্চলের কাঁকড়ার চাহিদা বেশি।
আর এক কাঁকড়া ব্যবসায়ী মহম্মদ আরিফ বিল্লাহ বলেন, ‘কাঁকড়ার প্রজনন মরসুম জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন কাঁকড়া প্রজনন মার্চ ও এপ্রিল মাসেও হচ্ছে। ফলে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ থাকায় বিদেশের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির ঘাটতি থাকায় এ অঞ্চলের চাষীরা কাঁকড়ার সর্বোত্তম উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কাঁকড়া চাষিরা জানান, তিন মাসের মধ্যে পুরুষ ও মহিলা জাতের কাঁকড়া বিদেশে রফতানি যোগ্য হয়। কাঁকড়া শৈত্য প্রবাহ ও দাবদাহে মারা যায় না। প্রতি কেজি চিংড়ি প্রকারভেদে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। আর কাঁকড়া ১ হাজার টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
বটিয়াঘাটা উপজেলার ভগবতিপুরের কাঁকড়া চাষি রতন সরকার বলেন, ‘এক সময় চিংড়ি ও কাঁকড়া একই ঘের বা পুকুরে চাষ করা হত। ভাইরাসের কারণে চিংড়ির ক্ষতি হতো। কাঁকড়ার উৎপাদনও ভাল হতো না। এখন কাঁকড়া চাষের আধুনিক পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা লাভবান হচ্ছেন। এখনও সঠিক প্রক্রিয়ায় কাঁকড়ার বীজ আনতে না পারার কারণে ২০-২৫ ভাগ কাঁকড়া মারা যাচ্ছে। তারপরও লাভ থাকছে। ৫০ শতক জমিতে প্রথম দফায় ৩৫ কেজি কাঁকড়া ছেড়ে ৫ হাজার টাকা লোকসান হয়। দ্বিতীয় দফায় একই কাঁকড়ায় ৪১ হাজার টাকা লাভ হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘১৫ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে কাঁকড়া বিক্রি করা যায়।’
কাঁকড়া রফতানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মহম্মদ মুসা শেখ বলেন, ‘বিশ্ব বাজারে সুন্দরবনের কাঁকড়ার চাহিদা ব্যাপক। এ অঞ্চলের কাঁকড়া অন্য যে কোনও জোনের চেয়ে সুস্বাদু। তাই আধুনিক চাষ পদ্ধতির প্রশিক্ষণ পাওয়া চাষিরা এখনই লাভবান হচ্ছেন। এককভাবে কাঁকড়া চাষে চাষিরা সমৃদ্ধ হচ্ছে।
তিনি বলেন,‘সরকার কাঁকড়া চাষের উন্নয়নে হ্যাচারি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে।’
খুলনার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মহম্মদ আবু সঈদ বলেন, ‘সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কাঁকড়া চাষের মরসুম। চাষ শুরু করে চাষীরা প্রতি মাসে ২ বার বিক্রিযোগ্য কাঁকড়া তুলতে পারেন। গুণগত মান ঠিক রাখতে পারলে কাঁকড়া রফতানির অবাধ সুযোগ রয়েছে। যা ক্রমাগত বাড়ছে।’