বিশ্বজিৎ মান্না
কয়েকমাস আগেও মানুষ যে ভাইরাসের নাম পর্যন্ত শোনেনি, আজ সেই ভাইরাস গোটা পৃথিবীর কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছে। অনেকে বলছেন, এখন সারা বিশ্বে যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা একমাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়কার প্রজন্মের অধিকাংশই এখন আর বেঁচে নেই। তাই সেই সময়ের চিত্র তুলে ধরা একটু কঠিন হতে পারে। বা বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেই সময়ের চিত্র অনুমান করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হতে পারে। তবে গোটা বিশ্বে আতঙ্ক বলতে কি বোঝায়, তা করোনাভাইরাসের সৌজন্যে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। এই ভাইরাস শুধু মানুষকে অসুস্থ করে দেওয়াই নয়, আরও নানা সমস্যা তৈরি করতে পারে। যেমন এই ভাইরাসের প্রভাবে গোটা বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মতো বড় বিপদের আশঙ্কাও করতে শুরু করে দিয়েছে। এবং তা কোনোভাবেই অমূলক নয়। করোনাভাইরাসের প্রথম উৎপত্তি হয়েছিল চিনে। এই ভাইরাসে শুধু চিনেই তিন হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। চিনের উহান প্রদেশ থেকে প্রথমে এই মারণ ভাইরাসের খবর পাওয়া যায়। পরে তা এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। চিনে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিকের দিকে এগোলেও ইরান, স্পেন, ইতালির মতো দেশে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ইতালিতে একদিনেই (গত রবিবার) করোনাভাইরাসে ৩৫০-এরও অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ভারতে করোনাভাইরাস
করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাদ যায়নি ভারতও। এখনও পর্যন্ত এদেশে মোট তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া শেষ খবর অনুযায়ী, আক্রান্তের সংখ্যা ১৩৭ জন। কেরল, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। এই সপ্তাহের শুরু পর্যন্তও করোনাভাইরাস মুক্ত ছিল পশ্চিমবঙ্গ। তবে চিন্তার বিষয় হল, খাস কলকাতাতেই এক যুবকের দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। এটাই পশ্চিমবঙ্গে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্তের নজির। দ্য হিন্দু পত্রিকার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, ইউনাইটেড কিংডম থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরে আসা এক পড়ুয়ার দেহে করোনাভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। রাজ্য সরকারের সিনিয়র আধিকারিকরা জানিয়েছেন, কলকাতার বেলেঘাটা আইডি হসপিটালে ওই পড়ুয়াকে আইসোলেশনে (পৃথকভাবে) রাখা হয়েছে। ওই পড়ুয়ার পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। তবে জানা গিয়েছে, গত ১৫ মার্চ তিনি দেশে ফেরেন। বাবা-মা এবং গাড়ির ড্রাইভার তার সংস্পর্শে এসেছেন। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গে মোট ১৮ জনকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন গন্তব্য থেকে এরাজ্যে ফিরে আসা ১২,০০০ জনেরও বেশি মানুষের করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে এইসব পরীক্ষার মধ্যে প্রথম পজিটিভ কেস হলেন বেলেঘাটা আইডি হসপিটালে ভরতি হওয়া পড়ুয়া।
করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ করার জন্য ইতিমধ্যে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সিনেমা হল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেকোনো প্রকার জনসমাগম এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই মারণ ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য ২০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গড়ে তুলেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতিমধ্যে রাজ্যে জারি করা হয়েছে এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট।
সুন্দরবনে করোনাভাইরাস আতঙ্ক
সারা দেশের মতো সুন্দরবনেও করোনাভাইরাস নিয়ে তীব্র আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সুন্দরবনের অনেক বাসিন্দা শ্রমিক হিসেবে কেরলে কাজ করেন। কেরল থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। তাই সুন্দরবনের বাসিন্দারাও এই মারণ ভাইরাস নিয়ে ভীত। বিশেষত যাদের পরিবারের সদস্যরা কেরলের মতো ভিন রাজ্যে কাজের জন্য রয়েছেন, তাদের আতঙ্ক আরও বেশি। এদিকে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ মহকুমা হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে কাউকে যদি নিয়ে আসা হয়, সেই উদ্দেশে আইসোলেশন ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে। চার শয্যা বিশিষ্ট এই ওয়ার্ডে করোনাভাইরাস চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা আছে।
আতঙ্ক ছড়াবেন না, বরং সতর্ক থাকুন
করোনাভাইরাসকে বলা হচ্ছে এটি একটি নভেল ভাইরাস। অর্থাৎ এর অস্তিত্বের কথা আগে জানা যায়নি। তাই এই ভাইরাসের মোকাবিলা করতে গিয়ে একটু হলেও ফাঁপরে পড়তে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকছে না। অবশ্য গবেষকরা ইতিমধ্যে দিন-রাত এক করে এই মারণ ভাইরাসকে জব্দ করার ওষুধ তৈরিতে সচেষ্ট হয়েছেন। মিডিয়া রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, আমেরিকায় এরকমই একটি ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। ফল পাওয়া গেলে ভারতেও চলে আসবে এই ওষুধ।
করোনাভাইরাস নিয়ে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই অযথা আতঙ্ক ছড়াবেন না, কিংবা গুজবে কান দেবেন না। আমরা যদি কিছু সহজ পন্থা অবলম্বন করি, তাহলে এই ভাইরাসকে দূরে রাখতে পারব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু এই মর্মে সারা বিশ্বে প্রচার চালু করেছে। সেখানে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলি এই রিপোর্টে তুলে ধরা হল।
নিয়মিত হাত পরিষ্কার করুন
অ্যালকোহল ভিত্তিক হ্যান্ডওয়াশ বা সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত ধুয়ে নিন। এর ফলে আপনার হাতে যদি জীবাণু থাকে, তাহলে সেটি মারা যাবে।
দূরত্ব বজায় রাখুন
আপনার আশেপাশে কিউ যদি হাঁচেন বা কাশেন, তার থেকে অন্তত ১ মিটার (৩ ফুট) দূরত্ব বজায় রাখুন। কেউ যখন হাঁচেন বা কাশেন, তখন তার মুখ এবং নাক থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লিকুইড ড্রপলেট বেরোয়, যেগুলিতে ভাইরাস থাকতে পারে। আপনি যদি সেই ব্যক্তির খুব নিকটে থাকেন, তাহলে আপনার নিঃশ্বাসের মাধ্যমে সেই ভাইরাস আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যে ব্যক্তির কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস রয়েছে, তিনিও যদি হাঁচেন বা কাশেন, তার সামনে থাকলে অনুরূপভাবে এই মারণ ভাইরাস আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
চোখ, নাক এবং মুখে হাত দেবেন না
আমাদের হাত বিভিন্ন জায়গা স্পর্শ করে। ফলে হাতে ভাইরাস থাকতে পারে। হাত যদি একবার ভাইরাসের সংস্পর্শে আসে, তাহলে এটি আপনার চোখ, মুখ এবং নাকে প্রবেশ করতে পারে।
পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করুন
আপনি এবং আপনার চারপাশে থাকা প্রত্যেকেরই পরিচ্ছন্ন থাকা উচিত। মুখে মাস্ক ব্যবহার করুন। হাঁচি বা কাশি পেলে রুমাল দিয়ে মুখ ঢাকুন। কারণ হাঁচি বা কাশির সময় আপনার নাক-মুখ থেকে বেরোনো ড্রপলেটের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে।
জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট হলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখান
অসুস্থ বোধ করলে বাড়িতে থাকুন। যদি জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট হয়, তাহলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখান। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।
তথ্যসূত্র- হু, ছবি সৌজন্য দ্য হিন্দু।