বিশ্বজিৎ মান্না
গত বছর চিনের উহান শহরে প্রথমবার কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হয়। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের ৭০টিরও অধিক দেশে এই মারণ ভাইরাসের প্রকোপ দেখা গিয়েছে। চিন, ইরান, ইতালি ও স্পেনের মতো দেশগুলিতে করোনাভাইরাস ইতিমধ্যে মহামারি সৃষ্টি করেছে। একাধিক মিডিয়া রিপোর্টে দাবি করা হয়েছিল, করোনাভাইরাস কৃত্রিমভাবে বানানো হয়েছে। যদিও এমন সম্ভাবনার কথা সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দিয়েছেন গবেষকরা। নেচার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে এমনটাই বলা হয়েছে।
করোনাভাইরাস থেকে জিনগত ডেটা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ভাইরাসের বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, করোনাভাইরাস কোনো পরীক্ষাগারে বা অন্য কোথাও কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়নি। স্ক্রিপস রিসার্চে ইমিউনোলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজির সহকারী অধ্যাপক ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসেন বলেন, করোনাভাইরাসের জিনগত ডেটা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই করোনাভাইরাসের (SARS-CoV-2) উৎপত্তি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, অ্যান্ডারসন ছাড়াও “The proximal origin of SARS-CoV-2” শীর্ষক এই গবেষণাপত্রের অন্যান্য লেখকদের মধ্যে রয়েছেন তুলানে ইউনিভার্সিটির রবার্ট এফ. গ্যারি, সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এডওয়ার্ড হোমস, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্ড্রু রামবাউট, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডব্লু. ইয়ান লিপকিন।
করোনাভাইরাস হল একটি বৃহত্তর শ্রেণীর অন্তর্গত এমন এক প্রকারের ভাইরাস, যা মানুষের শরীরে নানা ধরণের সমস্যা তৈরি করতে পারে। করোনাভাইরাসের প্রথম উৎপত্তি দেখা দিয়েছিল ২০০৩ সালে। সেই বছর চিনে সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (এসএআরএস) মহামারিতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ২০১২ সালে সৌদি আরবে ফের এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা যায়, যা মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিস্টেম (এমইআরএস) নামে পরিচিত ছিল।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চিনা কর্তৃপক্ষ ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনকে সতর্ক করে জানিয়েছিল, চিনে একপ্রকার নতুন বা নভেল করোনাভাইরাস দেখা দিয়েছে। এই ভাইরাসে মানুষ গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এই ভাইরাসকেই পরবর্তীতে SARS-CoV-2 বা কোভিড-১৯ বলা হয়। ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখ অনুযায়ী কোভিড-১৯ এ প্রায় ১৬৭,০০টি নজির নথিবদ্ধ করা হয়েছে। যদিও অনেক মাইল্ড কেস এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই ভাইরাসে সমগ্র বিশ্বে প্রায় ১০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পরই চিনা বিজ্ঞানীরা SARS-CoV-2-এর জিনগত সিকোয়েন্স খতিয়ে দেখা শুরু করেন। সমগ্র বিশ্বের গবেষকদের সঙ্গে তারা এই বিপুল ডেটা শেয়ারও করেন। জিনগত সিকোয়েন্স ডেটায় দেখা গিয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই মহামারিকে চিহ্নিত করেছে। মূলত আক্রান্ত একজন মানুষ যখন অন্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেন, তখনই এই ভাইরাস ছড়ায়। ঠিক এইভাবেই কোভিড-১৯ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অ্যান্ডারসন এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে তার সহযোগী গবেষকরা এই তথ্য ব্যবহার করে করোনাভাইরাসের উৎস সন্ধানের চেষ্টা করেছেন।
মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী দেহের কোষগুলিতে কিভাবে এই ভাইরাস প্রবেশ করে তার জন্য জেনেটিক টেমপ্লেট নিয়ে গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। এর জন্য তারা ভাইরাসের বাইরে থাকা স্পাইক প্রোটিন এবং আরমেচিউরের উপর নজর দিয়েছেন। এছাড়া তারা স্পাইক প্রোটিনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য: রিসেপ্টর বিল্ডিং ডোমেন (আরবিডি), একধরণের হুক যা হোস্ট সেলকে এবং ক্লিভেজ সাইটকে আঁকড়ে ধরে। একটি মলিকিউলারের সাহায্যে এই ভাইরাসে কোষের মধ্যে ঢুকতে পারে।
প্রাকৃতিক বিবর্তনের প্রমাণ
বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন যে SARS-CoV-2 স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশ মানব দেহের কোষের (ACE2) বাইরে মলিকিউলার বৈশিষ্ট্যকে কার্যকরীভাবে টার্গেট করে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে, যেটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে জড়িত একটি রিসেপ্টর হিসেবেও পরিচিত। SARS-CoV-2 স্পাইক প্রোটিন মানুষের শরীরের কোষগুলিতে এতটাই কার্যকরী যে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, করোনাভাইরাস প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ফলেই উৎপত্তি হয়েছে। এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়নি।
SARS-CoV-2-এর মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত ডেটার উপর নির্ভর করে এটির সামগ্রিক মলিকিউলার পরিকাঠামোয় প্রাকৃতিক বিবর্তনের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। প্যাথোজেন হিসেবে যদি কেউ একটি নতুন করোনাভাইরাস তৈরি করতে চাইতেন, তারা অসুস্থতা সৃষ্টিকারী ভাইরাস হিসেবে পরিচিত একটি ভাইরাসের থেকেই এটি তৈরি করতে পারতেন। তবে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন যে SARS-CoV-2-এর মেরুদণ্ড ইতিমধ্যে জ্ঞাত করোনাভাইরাসগুলির থেকে অনেকাংশেই পৃথক এবং অনেকাংশেই বাদুড় এবং প্যাঙ্গোলিনে পাওয়া ভাইরাসের সঙ্গে মিল রয়েছে।
অ্যান্ডারসেন বলেন, ভাইরাসের এই দুটি বৈশিষ্ট্যে, স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশে মিউটেশন এবং এটির স্পষ্ট মেরুদণ্ড, SARS-CoV-2-এর সম্ভাব্য উৎস হিসেবে ল্যাবরেটরিতে কোনোপ্রকার কারসাজির সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়।
জোসি গৌল্ডিং, ইউকে ভিত্তিক ওয়েলকাম ট্রাস্টের এপিডেমিকস লিড বলেন, অ্যান্ডারসেন এবং তার সহকর্মীদের গবেষণার এই ফল কোভিড-১৯ এর ভাইরাস (SARS-CoV-2)-এর উৎস নিয়ে যে গুজব ছড়িয়েছে, সেই ক্ষেত্রে একটি প্রমাণ ভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবে। গৌল্ডিং আরও যোগ করেন, তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে এই ভাইরাস প্রাকৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে উৎপত্তি হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে যে জল্পনা তৈরি হয়েছিল, এবার সেটা বন্ধ হবে।
ভাইরাসের সম্ভাব্য উৎস
জিনগত সিকোয়েন্সিং বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অ্যান্ডারসেন এবং তার সহগবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, দুটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি থেকে SARS-CoV-2-এর সৃষ্টি হতে পারে।
একটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি হল, মানুষ ছাড়া অন্য কোনো হোস্টে স্বাভাবিক সিলেকশনের মাধ্যমে ভাইরাসটি বর্তমান প্যাথোজেনিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পূর্বেকার করোনাভাইরাসেকর এইভাবেই উৎপত্তি হয়েছিল। সিভেট (SARS) এবং উটের (MERS) সংস্পর্শে সরাসরি আসার পর মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। গবেষকদের অনুমান, বর্তমানে যে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে, তা বাদুড়ে পাওয়া ভাইরাসের মতো। তাই SARS-CoV-2 বা কোভিড-১৯ এর একটি সম্ভাব্য উৎস হতে পারে বাদুড়। তবে বাদুড়ের থেকে মানুষের মধ্যে সরাসরি এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে, এরকম নথিবদ্ধ কোনো উদাহরণ নেই। তবে বিজ্ঞানীদের অনুমান, মানুষ এবং বাদুড়ের মধ্যে যেকোনো একটি এই ভাইরাসের ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট হতে পারে।
আর একটি দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ভাইরাসের নন-প্যাথোজেনিক সংস্করণ কোনো প্রাণীর মধ্যে থেকে মানুষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। তারপর সেটি বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানুষের মধ্যে বর্তমানে বিস্তার করা প্যাথোজেনিক রূপ নিয়েছে।