বিশ্বজিৎ মান্না
ভারতে এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সোমবার থেকে গোটা দেশে লকডাউন জারি করা হয়েছে। চিনের পর এবার স্পেন, ইতালির মতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯।
যেহেতু এই ভাইরাসটি নতুন, তাই এটির চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার সবচেয়ে সেরা উপায় হল পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন থাকা। অনেকে বাইরে খাওয়াদাওয়া করা বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেকে আবার মাংস এবং পোল্ট্রিজাতীয় খাবার ছেড়ে কেবলমাত্র শাক-সব্জি খাওয়ার দিকে ঝুঁকছেন। এই আতঙ্কের জেরে ব্রয়লার চিকেনের দাম অস্বাভাবিক ভাবে কমে গিয়েছে। মাংস ছেড়ে শাক-সব্জি খাওয়াটাই কি করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সবচেয়ে নিরাপদ উপায়? এটা কি আপনাকে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারে? একেবারেই না।
করোনাভাইরাস হল রেসপিরেটরি ইনফেকশন যা বাতাসে সঞ্চালিত ড্রপলেটসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরকম কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে ব্রয়লার মুরগি, মাংস বা সিফুডে করোনাভাইরাস বা অন্য কোনো ভাইরাস থাকতে পারে। ডিমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ব্রয়লার মুরগির মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে, এই ধরণের গুজবের পিছনে মূল কারণ লুকিয়ে রয়েছে চিনে। চিনের উহানে একটি পোল্ট্রি মার্কেট থেকেই প্রথমে করোনাভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, পোল্ট্রি মার্কেটে করোনাভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল মানেই এটা ধরে নেওয়া যাবে না যে পোল্ট্রিজাত খাবারের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায়। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, করোনাভাইরাস মানুষের দেহে বাসা বাঁধতে পারে। তবে এই মারণ ভাইরাস খাবারের মধ্যে বৃদ্ধি পায় না। সুতরাং একটি কথা স্পষ্টভাবে বলা যায়, মাংস বা পোল্ট্রিজাত খাবারের সঙ্গে করোনাভাইরাসের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে একটি কথা মাথায় রাখতে হবে, সাবধানতামূলক পন্থা হিসেবে চিকেন খুব ভালোভাবে (ন্যূনতম ৩০ মিনিট ধরে) রান্না করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় চিকেনে যদি কোনো ভাইরাস আদৌ থাকে, তাহলে সেটির মৃত্যু হবে। কারণ যে তাপমাত্রায় রান্না করা হয়, সেই তাপমাত্রায় ভাইরাস বেঁচে থাকতে পারে না। কোভিড-১৯ এর মতো সার্স ভাইরাস খতম করতে একই পদক্ষেপ কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে নভি মুম্বইয়ের অ্যাপোলো হসপিটালসের ইনফেকশাস ডিজিজের কনসাল্ট্যান্ট ডা. লক্ষ্মণ জেসানি মনে করেন, যতক্ষণ আমরা প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করি, ততক্ষণ কোনো খাবারই অসুরক্ষিত নয়।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য একটি হোস্ট (মানুষের শরীর) প্রয়োজন। এটি খাবারের মধ্যে বাড়তে পারে না। খাবারের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত এরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে কোনো প্রকার ইনফেকশনের উপাদান বা ভাইরাস খাবারের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। সুতরাং নন-ভেজিটেরিয়ান খাবার খাওয়া সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ। তবে আমাদের কিছু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। দেখতে হবে মাংস যেন ঠিকঠাক পরিষ্কার করে উচ্চ তাপমাত্রায় যথাযথভাবে রান্না করা হয়। এছাড়া কাঁচ ফল ও সব্জি খাওয়ার আগেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া যতদিন না ভাইরাস (করোনাভাইরাস) সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আসছে, ততদিন পর্যন্ত সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে আমরা কসাইখানার আশেপাশে না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।
একই মন্তব্য করেছেন অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস (এইমস) –এর ডিরেক্টর ডা. রণদীপ গুলেরিয়া। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, কোনোপ্রকার মাংস বা পোল্ট্রিজাতীয় খাবারের মধ্যে কোনো ঝুঁকি নেই। চিকেন নিয়ে গুজবের ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, সাবধানতা হিসেবে সমস্ত প্রকার মাংস যথাযথভাবে ধোয়ার পর রান্না করা উচিত।
চিকিৎসকদের এই ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট যে, যেকোনো প্রকার মাংস ঠিকঠাক ধোয়ার পর নির্ধারিত পদ্ধতি অনুযায়ী, দীর্ঘসময় ধরে রান্না করলে তাতে কোনো ঝুঁকি থাকে না। এর পাশাপাশি ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা হু এরকম কোনো ইঙ্গিত প্রদান করেনি যে খাবারের মাধ্যমে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে।
বাইরে খাওয়া বা অর্ডার করা খাবার কি নিরাপদ?
আপনি যদি এই মুহূর্তে বাড়ির বাইরে থাকেন, বা খাবার অর্ডার করেন, তাহলে খাবার সরবরাহকারী এবং প্রস্তুতকারীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে নিশ্চিত হোন। কাঁচা খাবার এবং রান্না করা খাবারের মধ্যে কোনোপ্রকার সংক্রমণ এড়াতে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া টেবিলে রাখা জিনিসপত্র স্পর্শ করার ব্যাপারেও আপনাকে সচেতন থাকতে হবে। খাবারের মাধ্যমে করোনাভাইরাস না ছড়ালেও টেবিলের উপরিভাগ, বাসনপত্র, মেনুকার্ড, যেগুলি প্রায়শই স্পর্শ করা হয়, এগুলির মাধ্যমে মারণ ভাইরাস ছড়াতে পারে। এছাড়া অসুস্থ বা কোনো মেডিকেল সমস্যা রয়েছে, এই সময় তাদের বাইরে বেরোনো একেবারেই উচিত নয়। একান্ত বেরোতে হলে প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে সেলফ-কোয়ারেন্টাইন হল সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা।
এছাড়া রেস্তোরাঁয়ায় যখন ভিড় থাকে, তখন পারলে না যাওয়ার চেষ্টা করুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।
তথ্যসূত্র – টাইমস অব ইন্ডিয়া