সুপর্ণা দাস
(১)
একটু আগেও ছপাৎ ছপ শব্দটা শোনা যাচ্ছিল। এখন সব শুনশান। চারপাশে শুধু জমাট অন্ধকার আর একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক। কেমন জানি ঝিম লাগে মাথায়। তার ওপর শরীরটাও বড্ড নড়বড়ে ঠেকছে। তবে শরীরেরই বা আর দোষ কী! এই ক’দিন যা ধকল গিয়েছে! প্রথম তিনদিন তো খাটুনিই সার। গোটা তল্লাট ঢুঁড়েও দুখেদের কপালে এক ঝিনুক মধু জোটেনি। মেলেনি এক চিমটে মোমও। অথচ আজ সকাল থেকেই দ্যাখো! কী কাণ্ড! এত মধু আর মোম যে ধনা মৌলির সাত-সাতটা ডিঙি উপচে পড়ার জোগাড়! রাতারাতি জঙ্গলের এমন ভোলবদল কী করে হল, এখনও সেই হিসাবই কষছে দুখে। এদিকে, পেট চুঁই চুঁই। তার ওপর খাস দক্ষিণ রায়ের তালুকে এখন সে পথভোলা পথিক। নিজের ওপর ভারী রাগ হচ্ছিল দুখের। নিজের বোকামির জন্যই আজ তার এই দশা। না হলে সোঁদরবনের জঙ্গলে মৌচাক ভাঙতে এসে কেউ দলছুট হয়! এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই দুখেরমনে হল গলাটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছিল, বাচ্চাদের মতো গলা ছেড়ে ভ্যাঁ করে কাঁদে। কিন্তু তাতে লাভটা কী হবে শুনি! কিস্যু হবে না। তাই আপাতত কোনও কান্নাকাটি নয়। আগে তাকে এই কেঁদোখালির চর থেকে আস্ত বেরোনোর রাস্তা খুঁজতে হবে। তারপর গ্রামে ফেরার ব্যবস্থাও করতে হবে। তারপর না হয় ভাঙা ঘরের মেঝেয় বসে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদবে। কিন্তু আর তো পারা যাচ্ছে না। বাদাবনের জঙ্গলে এভাবে খালি পায়ে কাঁহাতক হাঁটা যায়। এবার যে একটু না জিরোলেই নয়।
(২)
সমুদ্দুর এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। কাছেই মোহনা। এমন দুপুর রোদে নদীর দিক থেকে বয়ে আসা ভিজে হাওয়া খেতে ভালোই লাগে দুখের। একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে ঘাসের ডগা চিবোচ্ছিল সে। গরুগুলো চরে বেড়াচ্ছিল সামনেই। দুখে ভাবছিল, নামখানি তার বেশ মানানসই বটে। যে ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সে ঘরের ছেলের এই নাম হবে না তো কী! তবে এখন সে জোয়ান মরদ। তাই অভাব ঘোচানোর রাস্তা খুঁজতেই হবে দুখেকে। সেই রাস্তার খোঁজেই হয়তো মন দিয়ে মাথা খাটাচ্ছিল দুখে। হুঁশ ফিরল ধনা মৌলির হাঁকাহাঁকিতে। অবিশ্যি আজ বড় সুরেলা সে ডাক! ধনার এখন ভারী বিপদ। সাত-সাতটা ডিঙি তৈরি। সেইসব নিয়ে জঙ্গলে, মানে যেখানে কাকপক্ষীও ঘেঁষতে ভয় পায়, এমন গভীর বনে যাবে সে। নৌকা ভরে আনবেমধু আর মোম। তারপর তা বেচেঘরে তুলবে মোটা মুনাফা। এক্কেবারে পাক্কা ছক। অথচ এখন তার গোটাটাই ভেস্তে যাওয়ার জোগাড়। ধনার ভাই মনা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, মোটা মুনাফার লোভে প্রাণের মায়া ত্যাগ করতে পারবে না সে। কিছুতেই ঢুকবে না দক্ষিণ রায়ের তালুকে। তাই দুখেই এখন ধনা মৌলির মুশকিল আসান। তাকে নিয়েই দূর জঙ্গলে, কেঁদোখালির চরে যেতে চায় ধনা। ডিঙি ভরে আনতে চায় মধু আর মোম। তাতে দুখের দু’পয়সা রোজগারও হবে। ধনার প্রস্তাবটা মনে ধরেছিল দুখের। তলপি-তলপা নিয়ে ধনার ডিঙিতে চড়ে বসেছিল সে। তবে ছেলের এমন ‘উন্নতি’তেও কেনজানি কু ডেকেছিল মায়ের মন। ঘর ছাড়ার আগে দুখেকে পই পই করে বলে দিয়েছিল সে, যখনই মাঝ জঙ্গলে কোনও বিপদ হবে, দুখে যেন বনবিবির শরণ নেয়।
(৩)
ক‘দিন আগের ঘটনাগুলোই ঘুরেফিরে এসেছিল স্বপ্নে। বড় দিশেহারা লাগছিল তার। ওই। আবার। সেই বোঁটকা গন্ধটা। যেন তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ভয় লাগছে দুখের। অন্ধকার ফুঁড়ে তার দিকে এগোচ্ছে একজোড়া চোখ। তাতে আগুনঝরা নজর। এ কে? হলদে কালো ডোরায় এ যে মানুষখেকো যম।।
(৪)
না। গল্পের ইতি এখানে হয়নি। তার কথা ফুরিয়ে নটে গাছ মুড়োতে সময় লেগেছিল বিস্তর। তবে গল্প? নাকি জনশ্রুতি? নাকি লোকগাথা? যুগ যুগ ধরে যার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে বাদাবনের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস বলে, সেই ভয়ঙ্কর রাতে দুখের সহায় হয়েছিলেন বনবিবি। আসলে মধু আর মোমের লোভে সটান দক্ষিণ রায়ের ডেরায় হাজির হয়েছিল ধনা মৌলি। কিন্তু দক্ষিণ রায়কে কোনও উপঢৌকন না দিয়েই কাজে নেমেছিল সে। তার ফল যা হওয়ার তাই হল। তিনদিনের পরিশ্রম বৃথা গেল। হাজার চেষ্টা করেও মধু-মোমের খোঁজ পেল না ধনা। শেষমেশ তৃতীয় রাতে তার স্বপ্নে দেখা দিলেন দক্ষিণ রায়। লোকগাথা বলে, এই দক্ষিণ রায় নাকি আদতে রাক্ষসরাজ। বিস্তর তর্কাতর্কির পর তাঁর সঙ্গে সন্ধি হয় ধনা মৌলির। স্থির হয়, নরবলির বদলে সাত ডিঙিবোঝাই মধু আর মোম পাবে ধনা। তাই সুযোগ বুঝেই দুখেকে কেঁদোখালির চরের গভীর জঙ্গলে ফেলে পালায় ধনা। বাঘের ছদ্মবেশে দুখেকে খেতে আসেন দক্ষিণ রায়। প্রাণ বাঁচাতে বনবিবির শরণাপন্ন হয় দুখে। তার আর্তিতে ছুটে আসেন দেবী। সঙ্গে তাঁর ভাই শাহ জঙ্গলি। শাহের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধে হেরে পালাতে হয় দক্ষিণ রায়কে। বরা খান গাজির কাছে আশ্রয় নেন তিনি। তাঁকে তাড়া করে সেখানেও পৌঁছে যান বনবিবি। শেষমেশ গাজির মধ্যস্থতায় মীমাংসা হয় দু’পক্ষের। দক্ষিণ রায়কে ক্ষমা করে দেন দেবী। বনবিবির প্রিয় ভক্ত দুখেকে পিঠে চড়িয়ে তার গ্রামে পৌঁছে দেয় দেবীর পোষ্য কুমির সেকো। শুধু তাই নয়। দুখের কপালে জুটে যায় মোটা ‘ক্ষতিপূরণ’। গাজি তাকে সাত গাড়িবোঝাই মূল্যবান পণ্য উপহার দেন। দক্ষিণ রায় দেন প্রচুর মোম আর মধু। পরে ধনা মৌলির মেয়ে চম্পার সঙ্গেই বিয়ে হয় দুখের। দুঃখ পিছনে ফেলে তখন সে গাঁয়ের চৌধুরী। বনবিবির প্রধান প্রচারক।
(৫)
ঠিক কোন পরিস্থিতিতে এমন লোকগাথার জন্ম হয়েছিল, তা অবশ্য গবেষণার বিষয়। কোনও এক সময় আমরা সেসব নিয়েও সাধ্য মতো, সহজ ভাষায় তথ্য পরিবেশনের চেষ্টা করব। রাক্ষসরাজ দক্ষিণ রায় বাঘের ছদ্মবেশ ধারণে কতটা সক্ষম তা আমরা জানি না। তবে আজও সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গলকে দক্ষিণ রায় বলেই ডাকে বাদাবনের মানুষ। তাকে তারা ভয় পান, সম্মানও করেন। এক সময় যার উপস্থিতিতে মিথের পাল্লা ছিল ভারী, আজ তাকে নিয়েই গবেষণা করে বিজ্ঞান। উঠে আসে নিত্যনতুন অজানা তথ্য। তবু আজও দক্ষিণ রায়ের মোকাবিলায় বনবিবিকেই স্মরণ করে সুন্দরবন। বাংলার মাটিতে এই লোকদেবীর আগমনের কাহিনীও কম রোমাঞ্চকর নয়। সে গল্প না হয় আর একদিন হবে।